-মুজিব মাসুদ ও জিয়াউল গনি সেলিম
গ্রামীণফোনের কলড্রপ ও দুর্বল নেটওয়ার্কে এবার চরমভাবে চটেছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানীতে নিজ গ্রামের বাড়িতে দীর্ঘদিন থেকে গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক সমস্যায় ভুগছেন তিনি। গত দুই বছর আগে নিজ এলাকার এ দুর্বল নেটওয়ার্ক সমস্যা নিয়ে গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও এর কোনো সমাধান হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।
বুধবার দুপুর দেড়টার দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি এমন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছেন। প্রতিমন্ত্রীর স্ট্যাটাস দেয়ার পর পরই এনিয়ে দেশব্যাপী প্রতিক্রিয়ার ঝড় উঠে। মাত্র ৫ ঘণ্টায় প্রতিমন্ত্রীর স্ট্যাটাসের নিচে মন্তব্য করেছেন বিপুলসংখ্যক ক্ষুব্ধ জিপি গ্রাহক। এসব মন্তব্যে তারা গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি তুলেছেন। অনেকে গ্রামীণফোনকে হারামি ফোন, সন্ত্রাসীফোন, ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি, নীরব শোষক, গলাকাটা ডাকাত বলে মন্তব্য করেছেন। একজন গ্রাহক প্রতিমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তার মন্তব্যে লিখেছেন, মাননীয় প্রতিমন্ত্রী আমরা সবাই আপনার সঙ্গে আছি। এই হারামি ফোনকে শাস্তির আওতায় আনুন। দ্রুত এমএনপি (মোবাইল নম্বর প্রোটেবিলিটি) সুবিধা চালু করুন। তাহলে জিপির গ্রাহক কমে ২০ লাখে নামবে। কেউ বলেছেন, জিপির ইন্টারনেট মানে এক প্রকার দুঃস্বপ্ন। একজন বলেছেন, দয়া করে টেলিটক নেটওয়ার্কের উন্নয়ন ঘটান। গ্রামীণ ডাকাতের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করুন।
খোদ টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম তার কমেন্টে লিখেছেন, আমি বারবার তাদের (গ্রামীণফোন) কলড্রপ সমস্যাসহ অন্যান্য সেবার মান বাড়াতে
বলেছি। মনে হচ্ছে সেবা দেয়ার চেয়ে অর্থ উপার্জনের দিকে তাদের ঝোঁক বেশি। তারা আমাদের মূল্যবান অংশীদার, এখনই সময় হয়েছে সে অনুসারে কাজ করার।
শুক্রবার থেকে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম রাজশাহীস্থ তার নিজ বাড়িতে অবস্থান করছেন। গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানীতে অবস্থানকালে তিনি বেশিরভাগ সময়ই গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক নিরবচ্ছিন্নভাবে পাচ্ছিলেন না। ফিলিং অ্যাংরি বলে পোস্ট করা স্ট্যাটাসে শাহরিয়ার আলম উল্লেখ করেন, জিপির কী সমস্যা? কল করা সম্ভব হচ্ছে না। দুই মাস আগে কল ড্রপ হওয়ার পর তারা এসএমএসের মাধ্যমে দোষ স্বীকার করেছিল। এছাড়া আড়ানীতে নেটওয়ার্ক অনেক খারাপ। আমি আমার বাসার ফাস্ট ফ্লোরের বেডরুম (শোবার ঘর) থেকে অনেক কষ্ট করে নেটওয়ার্ক পেতে হচ্ছে। আমার বাসভবনের এখানে কোনো ধরনের ভবন নেই যে তাতে সিগন্যাল দুর্বল হবে। বিষয়টি দেখার জন্য আমি দুই বছর আগে তাদের অনুরোধ করেছিলাম কিন্তু কোনো উন্নতি হয়নি।
বুধবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত শাহরিয়ার আমলের স্ট্যাটাসের নিচে অনেকে মন্তব্য করেছেন। এর মধ্যে ১ হাজার ১০৫টি লাইক, ১৬৪টি টপমোস্টসহ সহস্রাধিক কমেন্টস ও অর্ধশত শেয়ার দেখা গেছে। এসব মন্তব্যে গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ উঠেছে এসেছে।
ইন্টারনেটের চার্জ কমানোর উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানিয়ে কৃষিবিদ সাজ্জাদ হোসাইন নামের এক ফেসবুক ব্যবহারকারী মন্তব্য করেছেন, জিপি যেভাবে আমাদের গলা কাটছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে বড় বাধা এটা। ওমর ফারুক ফারদিন লিখেছেন, লিডার, এটা তো ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি। নীরব শোষণ। রাজশাহীতে সিগন্যাল অনেক দুর্বল। আমরা কথা বলার সময় অনেক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি- এমনটি লিখেছেন ফেসবুক ব্যবহারকারী হেলালুদ্দিন আহমেদ। কলড্রপ বেশি টাকা কেটে নেয়ার একটা ফাঁদ বলে মনে করেন রুপন রহমান। সালাহউদ্দিন আর সাকা গ্রামীণফোনকে হারামিফোন বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি লিখেছেন, গ্রামীণফোন ওরফে হারামিফোন।
মো. আলিমুল হক নামে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, লিডার, আড়ানীতে জিপি নেটের সমস্যা অনেক দিনের। আমরা এ সমস্যার সমাধান চাই আড়ানীবাসীর স্বার্থে। স্যার ইমার্জেন্সি ব্যালেন্স নেয়ার পরে শেষ না হতে পুনরায় লোড করলেই ওরা ইমার্জেন্সি ব্যালেন্স পুরোটাই কেটে নিচ্ছে। প্রতিদিন এভাবে পরিকল্পনা মাফিক কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ওরা। তাছাড়া ১২১-এ কল করলে কাস্টমার ম্যানেজারের জন্য মিনিট এর পর মিনিট অপেক্ষা করলেও লাইন ধরে না। দয়া করে ব্যবস্থা নিন। সায়েদ রুমান নামের এক ফেসবুক ব্যবহারকারী এমন মন্তব্য করেছেন।
বাবু পিকে নামের এক ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, লিডার, জিপি নেটওয়ার্ক ডাকাতি নেটওয়ার্ক। দয়া করে ব্যবস্থা নিন। আমাগো বাঁচান। মাননীয় প্রতিমন্ত্রী, সবাই সঙ্গে আছি। এই হারামিফোনকে শাস্তির আওতায় আনুন। দ্রুত এমএনপি সুবিধা চালু করেন। এদের গ্রাহক ২০ লাখে নামবেই। লিখেছেন রিপন কুমার সরকার পল্লব। প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বাচ্চু সরকার।
জাপানি দূতাবাসের কর্মকর্তা তন্ময় কুমার লিখেছেন, মান্যবর আমার ক্ষেত্রেও ঘটছে। গ্রামীণফোন ব্যবহার করে কি এটা আমাদের শিক্ষা?
ইমতিয়াজ আহম্মেদ শাওন লিখেছেন একই ধরনের সমস্যা হচ্ছে সারদাহ এলাকার মানুষের শোবার ঘরে। গত তিন বছর ধরে গ্রামীণফোনের এ দুর্বল নেটওয়ার্ক ও কলড্রপের বিরুদ্ধে অসংখ্যবার বলেও কোনো ফল পাননি গ্রাহকরা। প্লিজ, ব্যবস্থা নিন স্যার। শাকিল তালুকদার তার কমেন্টে লিখেছেন, তিনি সিলেট শহরে বসবাস করছেন। সেখানে বিপুলসংখ্যক জিপি টাওয়ার থাকলেও কোনো নেটওয়ার্ক নেই। নানা ধরনের সমস্যা হচ্ছে কল করতে। মইনুল ইসলাম লিখেছেন, জিপি হল গলাকাটা ডাকাত। যেতেও কাটে আসতেও কাটে। নেট খরচটা যদি কমানো যেত তাহলে খুব ভালো হতো। ওসমান মিয়া বলেছেন, জিপি চায় শুধু টাকা আর টাকা। গ্রাহকদের সেবা নিয়ে থোড়াই কেয়ার তাদের। চৌধুরী শামীম লিখেছেন, গ্রামীণফোন সম্পর্কে কিছুই বলার নেই। পুরোটাই রাবিশ। হাসান মেহেদী বলেছেন, বেশিরভাগ সময় তারা লাভ করা নিয়ে বেশি ব্যস্ত। সৈয়দ তানবীর আলিম লিখেছেন, আপনারই যদি এ সমস্যা ফেস করতে হয়, তাহলে অন্যদের কি অবস্থা তা তো বলাই বাহুল্য। রফিকুল ইসলাম রিজভী লিখেছেন, গ্রামীণফোনের অনিয়ম নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। এখনই সময় এসেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার। মাসুম আ রশিদ বলেছেন, গ্রামীণফোনের এ সমস্যা শুধু আড়ানীর নয়। পুরো দেশে তাদের এ সমস্যা। শেখ মারুফ হামিদ বলেছেন, ধন্যবাদ গ্রামীণফোনের দুর্বল নেটওয়ার্ক নিয়ে এ স্ট্যাটাস দেয়ার জন্য। কেউ একজন হলেও জনগণের কষ্ট নিয়ে গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। তানভীর আহম্মেদ লিখেছেন, গ্রামীণফোনকে কন্ট্রোল ও মনিটরিং করার কেউ নেই। সৈয়দ রোমান তার মন্তব্যে বলেছেন, ইমার্জেন্সি ব্যালেন্স নেয়ার পরে শেষ না হতে পুনরায় লোড করলেই ওরা ইমার্জেন্সি ব্যালেন্স পুরোটাই কেটে নিচ্ছে। প্রতিদিন এভাবে পরিকল্পনা মাফিক কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে গ্রামীণফোন। তাছাড়া ১২১-এ কল করলে কাস্টমার ম্যানেজারের জন্য মিনিট এর পর মিনিট অপেক্ষা করলেই লাইন ধরে না। দয়া করে ব্যবস্থা নিন। লিটন খান তার মন্তব্যে লিখেছেন, স্যার প্লিজ কিছু করেন, শুধু আপনি না আমরা অনেকেই এর ভুক্তভোগী। ঘরের ভেতরে কথা বলা যায় না। নেটওয়ার্ক থাকে না। ইন্টারনেট তো এক প্রকার দুঃস্বপ্ন। তৌফিক খান বলেছেন, লুটপাটের আখড়া হচ্ছে গ্রামীণফোন। আনলিমিটেড প্যাকেজ মাসিক সরকারি ভ্যাটের দোহাই দিয়ে সাধারণ মানুষের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রবাসে কল দিলে দেশের নম্বর উঠে না। কল রিসিভ করলেই ৮-১৫ টাকা পর্যন্ত কেটে নিচ্ছে। ইশতিয়াক আলী বলেছেন, জিপি একটি রক্তচোষা কোম্পানি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোবাইলে কলড্রপের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় অপারেটর গ্রামীণফোন। অপর দিকে কলড্রপের পাশাপাশি ইন্টারনেট সেবাতেও রয়েছে সবার পেছনে। সাড়ে পাঁচ কোটির বেশি গ্রাহকের অপারেটর গ্রামীণফোনের এ আচরণকে ভোক্তা অধিকার কর্মীরা বলেছেন এটা প্রতারণা। ভোক্তারা বলেছেন, কলড্রপের কারণে বাধ্য হয়ে গ্রাহককে বারবার কল করতে হচ্ছে। এতে প্রতি মাসে অপারেটরটি অতিরিক্ত শত শত কোটি টাকা আয় করছে। সাধারণ মানুষের পকেট কেটে গ্রামীণফোন প্রতারণার মাধ্যমে এ টাকা আয় করছে। সংশ্লিষ্ট বিটিআরসি বলছে, ঢাকাসহ সব বিভাগীয় সদর ও অন্যান্য জেলায় সরেজমিন থ্রিজি ও টুজি সেবা পরিস্থিতিসহ ৭টি প্যারামিটারে পর্যবেক্ষণ শেষে একটি সমীক্ষা চালায় সংস্থার প্রতিনিধি দল। পরে সব বেসরকারি অপারেটরের অফিসে গিয়েও নেটওয়ার্ক থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এতে দেখা গেছে, গ্রামীণফোনের কলড্রপ সবচেয়ে বেশি। আর ইন্টারনেট গতিতেও তারা সবার পেছনে।
টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গ্রামীণফোনের কলড্রপ সাম্প্রতিক সময়ে বেড়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে বলেন, বিষয়টি তারা গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানিয়েছেন। চিঠিতে গ্রাহকদের স্বার্থে উন্নত বিটিএস বসিয়ে শক্তিশালী ফ্রিকোয়েন্সি তৈরি করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু গ্রামীণফোন তাতে কর্ণপাত করছে না বলেও বিটিআরসির ওই কর্মকর্তা জানান। তবে তিনি বলেন, প্রথম দফায় চিঠি দেয়ার পর গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষ গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণ দেবে বলে ঘোষণা দিলেও বাস্তবে তা করেনি। নেটওয়ার্কের কারণে ভয়েস কলড্রপের পরিমাণ ভয়াবহ আকারে বেড়ে গেলে গ্রামীণফোনের পক্ষ থেকে প্রতি কলড্রপে এক মিনিট ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দেয়। আর সেটি ফলাও করে প্রচারও করে বিভিন্ন মিডিয়ায়। কিন্তু ২ দিন যেতে না যেতেই গ্রাহককে না জানিয়েই তা আবার বন্ধ করে দেয়। নিয়ম অনুযায়ী, গ্রাহককে কোনো অফার দেয়ার ক্ষেত্রে যেমনি বিটিআরসিকে জানাতে হবে তেমনি তা বন্ধ করার সময়ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও গ্রাহককে জানাতে হয়। কিন্তু গ্রামীণফোন নিয়ন্ত্রণ সংস্থার নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই অফারটি বন্ধ করে দেয়।
বিটিআরসি ফ্রিকোয়েন্সি বিভাগের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, সাড়ে ৫ কোটি গ্রাহক হলেও গ্রামীণফোন সে অনুপাতে নেটওয়ার্কে যে পরিমাণ জোর দেয়া প্রয়োজন, তা তারা দেয়নি। ফলে কলড্রপের ভোগান্তি বেড়ে গেছে।
Source