খবরের শিরোনামঃ ফাঁদ পেতেছে ভয়ঙ্কর সাইবার সন্ত্রাসী

খবরের তারিখঃ ২০১৫-১০-১৬

-রনক হাসান
আশির দশকের মাঝামাঝি দেশে ইন্টারনেট চালুর পর ব্যক্তিগত আক্রমণ বা আপত্তিকর ছবি-ভিডিও শেয়ারের মধ্য দিয়ে সাইবার সন্ত্রাস শুরু হলেও দিনে দিনে তা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সংঘবদ্ধ সাইবার সন্ত্রাসীরা ই-ভাইরাস আক্রমণ, রাষ্ট্রীয় ওয়েবসাইট হ্যাকিং, মেলওয়্যার স্পার্মিং, ফিশিং, আইডি ডুপ্লিকেটিংয়ের মাধ্যমে প্রতারণা এবং অনলাইনে তথ্য চুরি করে ব্যাংক ও মোবাইল অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ আত্মসাতের মতো দুর্ধর্ষ অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে ফাঁকি দিতে এ জগতের অপরাধীরা ইন্টারনেট ব্যবহার করে এরই মধ্যে সারাদেশে মাদক ব্যবসার জাল ব্যাপক হারে ছড়িয়ে দিয়েছে। চলছে ই-পাইরেসি, পর্নোগ্রাফি, ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি ও ক্রেকিংসহ নানা ধরনের সাইবার সন্ত্রাস। এ অপরাধের মধ্য দিয়ে রামুসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর অপচেষ্টারও একাধিক নজির রয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করলেও অপরাধীদের দক্ষতার সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পারায় পুলিশসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে মিছে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। কখনো কখনো সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাই সাইবার ক্রাইমের শিকার হয়েছেন। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ পরিসংখ্যান করে পুলিশ বলছে, দেশে সাইবার অপরাধীদের তৎপরতা গত এক বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। তবে আইটি বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সাইবার ক্রাইম গত কয়েক বছরে অন্তত দশগুণ বেড়ে দেশ রীতিমত ডেঞ্জার জোনে পৌঁছে গেছে। বিশেষ করে ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে তা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী অবুঝ শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ নর-নারী যে কেউ যে কোনো মুহূর্তে এ অপরাধের শিকার হচ্ছে। অনলাইন ট্রেডসহ এ মাধ্যমের সব লেনদেন ভয়ঙ্করভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি এখনও এতটা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেনি- এমন দাবি করে সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধ টিমের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভোরের পাতাকে বলেন, সাইবার অপরাধের শিকার অধিকাংশ মানুষ অভিযোগ না করায় তাঁরা প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছেন না। এ সুযোগে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তবে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, লোকবল সঙ্কট, প্রশাসনিক ও কাঠামোগত সমস্যা এবং বিটিআরসি, ফেসবুক, গুগল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে প্রয়োজনীয় সহযোগিতাবিষয়ক চুক্তি না থাকার অজুহাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী সাইবার সন্ত্রাসের শিকার অনেক মানুষকে নির্দ্বিধায় ফিরিয়ে দিচ্ছে। এতে জনগণের আস্থায় ভাটা পড়েছে। এছাড়াও সাইবার ক্রাইম আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় এ চক্র প্রতিনিয়ত নানা ভয়ঙ্কর অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। সাইবার সন্ত্রাসীদের একটি বড় অংশ সম্প্রতি অনলাইন শপিংয়ের নামে প্রতারণা, হয়রানি ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের ভয়ঙ্কর ফাঁদ ফেলেছে- এমন তথ্য পাওয়া গেছে ভোরের পাতার অনুসন্ধানে। তাদের জালে পড়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ হারানোর পাশাপাশি অনেকের স্বাভাবিক জীবনযাপন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। সম্ভ্রম হারানোর ভয়ে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার অনেক নারী আত্মহত্যার পথ খুঁজছেন। রাজধানীর একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে চাকরি করেন তরুণী সাদিয়া জামান স্বর্ণ। তিনি জানান, গত কিছুদিন আগে ফেসবুক অনলাইন শপ ‘কারুঘর’ থেকে তিনি একটি পুঁতির গহনা অর্ডার করেন। পণ্য পাঠানোর আগে তারা তাদের অনলাইন শপে ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে অফিসের ভিজিটিং কার্ড পাঠাতে বলে এবং ৬ ডিসেম্বর সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে অর্ডারকৃত পণ্যটি সরবরাহ করে। কিন্তু অনলাইনে নমুনাকৃত গহনার ছবির সঙ্গে পাঠানো পণ্যে বিস্তর ফারাক ছিল। বিষয়টি ফেসবুকে ক্ষুদে বার্তায় জানানোর পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। পণ্যের নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করা হলেও তারা টেলিফোনে হুমকি দিতে থাকে। এর পরপরই তারা ওই পণ্য গ্রহীতার ফেসবুক থেকে ছবি চুরি করে অশ্লীল ফেক ফেসবুক প্রোফাইল তৈরি করে। একইসঙ্গে একাধিক নোংরা ফেসবুক গ্রুপ ও ফেসবুক আইডি লাইকের মাধ্যমে সংযুক্ত হয়। ওই ফেক ফেসবুক আইডিতেও গ্রহীতার মুঠোফোন নাম্বার ছড়িয়ে দেয় তারা। স্বর্ণ জানান, বিষয়টি তিনি তাৎক্ষণিক ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে জানালেও কোনো কাজ হয়নি। অথচ ফেসবুকে থাকা তাঁর মোবাইল নাম্বারে ফোন করে তাঁকে নানা অশ্লীল প্রস্তাব দেওয়া হয়। যদিও ওই ফোন নাম্বারে পাল্টা কল করলে মোবাইল সংযোগে পাওয়া যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় সাধারণ ডাইরি করার পর সে রহস্য খুঁজতে গিয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ভয়ঙ্কর তথ্য পায়। জানা গেছে, সাইবার ক্রিমিনালদের একটি ফেসবুকে অনলাইন ব্যবসার ফাঁদ মেলে ক্রেতাদের মোবাইল নাম্বারসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করার পর নানাভাবে ক্রেতাদের ব্ল্যাকমেইল করছে। আর এ কাজে তারা অনলাইন প্রযুক্তির বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে নিজেদের মোবাইল ফোনের আইডি (শনাক্তকরণ নম্বর) গোপন রাখছে। আবার কখনো কখনো রিসিভ কলে বিদেশি কিংবা ভুয়া নাম্বার উঠছে। ফলে ফিরতি কল করে ওই সাইবার সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কথা বলা যাচ্ছে না। এমনকি গোয়েন্দারাও তাদের অবস্থান শনাক্ত করতে পারছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একই কৌশলে সাইবার অপরাধীরা বিপুলসংখ্যক বিকাশ এজেন্টের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করলেও তারা এর কোনো সুরাহা করতে পারছে না। এদিকে অনলাইনে মাদক বিক্রির পাশাপাশি দেহব্যবসা জেঁকে বসারও ভয়ঙ্কর তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দারা। অনুসন্ধানে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন, অনলাইনে দেহব্যবসা চালাতে সাইবার সন্ত্রাসীরা একাধিক ওয়েবপেইজ খুলে সেখানে দেহপসারিণীদের নগ্ন ছবিসহ বিস্তারিত তথ্য ও ফোন নম্বর পোস্ট করছে। এসব ওয়েবসাইটের ব্যাপক প্রচারের জন্য বিভিন্ন ধরনের বাঙালি মেয়ের আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও ফুটেজ ইউটিউবে আপলোড করা হচ্ছে। এছাড়াও ওই চক্রটি ইয়াবা, মদ, গাঁজা, হেরোইনসহ বিভিন্ন নেশাসামগ্রীও অনলাইনে অর্ডার নিয়ে তা ক্রেতার সুবিধামত জায়গায় পৌঁছে দিচ্ছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর পক্ষে মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। এদিকে পাকিস্তানসহ আন্তর্জাতিক কিছু হ্যাকারের সহায়তায় চলতি বছর সাইবার সন্ত্রাসীরা সরকারি-বেসরকারি অন্তত ৫৬টি ওয়েবসাইট হ্যাক করেছে। তারা বিভিন্ন সরকারি সংস্থা থেকে রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য চুরিরও চেষ্টা চালাচ্ছে বলে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন। বিষয়টি নিয়ে বিটিআরসি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, হ্যাকার গোষ্ঠীগুলোকে কোনোভাবেই আটকানো যাচ্ছে না। তারা একের পর এক সরকারি-বেসরকারি ওয়েবসাইটগুলোর ওপর হানা দিচ্ছে। যদিও পরে সাইটগুলো মেরামত করা হচ্ছে। কিন্তু এসব সাইট থেকে যে তথ্য চুরি হচ্ছে না- এটা বলা মুশকিল। চলতি বছরের শুরুর দিকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সরকারি ওয়েবসাইট হ্যাকারদের আক্রমণের শিকার হয়। অল্প ক’দিনের ব্যবধানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট দ্বিতীয়বারের মতো আক্রমণ করে সাইবার সন্ত্রাসীরা। এছাড়াও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর, বাংলাদেশ পুলিশ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ই-তথ্য কোষ ও সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইট হ্যাক করে একটি সংঘবদ্ধ হ্যাকার গ্রুপ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অনলাইন কার্যক্রমের নিরাপত্তা দুর্বলতার সুযোগে ব্র্যাক ব্যাংকের বেশ ক’জন গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে সাইবার সন্ত্রাসীরা বিপুল অঙ্কের অর্থ সরিয়ে নিয়েছে। যদিও আত্মসাৎকৃত অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের চাপে ব্র্যাক ব্যাংক পরিশোধ করতে বাধ্য হয়েছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেন, সাইবার ক্রাইম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের যথেষ্ট ধারণা না থাকায় এ অপরাধ দ্রুত বাড়ছে। এ অপরাধের শাস্তি সম্পর্কে সাইবার ক্রিমিনালদের জানা থাকলে তারাও এতটা বেপরোয়া হয়ে ওঠার সাহস পেত না। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অ্যান্টিসাইবার ক্রাইম টিমের এডিসি সানোয়ার হোসেন ভোরের পাতাকে বলেন, ‘আগে বিষয়টি অনেক সীমিত পরিসরে ছিল। এখন তা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। সাইবার ক্রাইম বিশ্বব্যাপী একটি বিষয়। অনেক সময় দেখা যায়, দেশের বাইরে বা আমেরিকায় বসে আমাদের দেশের ছবি বা ভিডিও তারা আপলোড করছে। সেক্ষেত্রে কিছু করার নেই। তবে আমাদের সাইবার ক্রাইম টিম কাজ করছে। এ ধরনের আরও বেশ কয়েকটি অভিযোগ এসেছে। আমরা খুঁজে খুঁজে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ (চলবে…)

Source