-বণিক বার্তায় অতিথি
মাহমুদ হোসেন। গ্রামীণফোনের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার। গতকাল আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে এসেছিলেন বণিক বার্তা কার্যালয়ে। কথা বলেছেন দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের বিভিন্ন দিক নিয়ে
টেলিযোগাযোগ খাত পুরোপুরি প্রযুক্তিনির্ভর। সেলফোন অপারেটরদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো স্পেকট্রাম বা তরঙ্গ। এটিকে এ খাতের ব্যবসায় কাঁচামালও বলা যেতে পারে। টেলিযোগাযোগ সেবার শুরুটা হয় তারের মাধ্যমে। শব্দকে তড়িত্শক্তিতে রূপান্তরের মাধ্যমে দূরবর্তী স্থানে পৌঁছে দেয়ার সুযোগ তৈরি হয় এতে। পরবর্তীতে তারবিহীন যোগাযোগের সূচনা। প্রাথমিকভাবে এটি সামরিক বাহিনীর ব্যবহারের উদ্দেশ্যে হলেও ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে চালু করা হয় সেলফোন সেবা। আশির দশকে এটি ব্যবহারের সুযোগ পায় জনগণ। এক্ষেত্রে উপযোগিতার ভিত্তিতে ব্যবহার হয় ভিন্ন ভিন্ন ব্যান্ডের তরঙ্গ। আর এজন্য ব্যান্ডগুলোর তরঙ্গমূল্যও আলাদা।
প্রথম প্রজন্মের সেলফোন সেবা ছিল ভয়েস কলনির্ভর। এর পর ডাটাভিত্তিক সেবার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। ফলে দ্বিতীয় প্রজন্মের সেলফোন সেবায় যুক্ত হয় জিপিআরএস ও ইডিজিই প্রযুক্তি। এর মাধ্যমে গ্রাহকদের ভয়েস কলের পাশাপাশি ডাটাভিত্তিক সেবাদান সম্ভব হলেও তা ছিল অন্তর্বর্তী একটি ব্যবস্থার মতো। ডাটা ব্যবহারের চাহিদা ক্রমেই বাড়তে থাকায় পরবর্তী প্রজন্মের সেলফোন সেবা হিসেবে এসেছে থ্রিজি। আগের দুটি প্রযুক্তির সঙ্গে এটির মূল পার্থক্য হলো দ্রুতগতির ডাটা ব্যবহারের সুযোগ।
২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত নিলামের মাধ্যমে অন্য সেলফোন অপারেটরদের সঙ্গে থ্রিজির লাইসেন্স ও তরঙ্গ বরাদ্দ নিয়েছে গ্রামীণফোনও। টুজি নেটওয়ার্ক বর্তমান অবস্থায় আনতে দেড় দশক সময় লাগলেও এরই মধ্যে দেশের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশেরও বেশি গ্রামীণফোনের থ্রিজি নেটওয়ার্কের আওতায় এসেছে। এক-দেড় বছরের মধ্যে জনসংখ্যার প্রায় শতভাগই এ নেটওয়ার্কের আওতায় আনা সম্ভব হবে। দ্রুততম সময়ে থ্রিজি নেটওয়ার্কের এ উন্নয়ন হয়তো বিশ্বে উদাহরণ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। দেশে ডাটাভিত্তিক সেবার চাহিদা যেভাবে বাড়ছে, তাতে থ্রিজি প্রযুক্তির বিদ্যমান সীমাবদ্ধতার পরিপ্রেক্ষিতে ফোরজি চালুর উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশে সেলফোন অপারেটররা ব্যবহার করছে ৯০০, ১৮০০ ও ২১০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের তরঙ্গ। এর মধ্যে প্রথম দুটি ব্যবহার করা হয় টুজি সেবা দেয়ার জন্য। আর ২১০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের তরঙ্গ ব্যবহার হচ্ছে থ্রিজি প্রযুক্তির সেবাদানের ক্ষেত্রে। বাধ্যবাধকতা থাকার কারণে বর্তমানে নির্দিষ্ট ব্যান্ডে নির্দিষ্ট প্রযুক্তিনির্ভর সেবা দেয়া হচ্ছে। ২১০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডে ফোরজি চালু করা সম্ভব। তবে এ ব্যান্ডে নেয়া তরঙ্গ থ্রিজির গ্রাহকদের সেবা দিতেই ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে ফোরজি চালুর জন্য ব্যান্ডটিতে আমাদের হাতে তরঙ্গ নেই। এজন্য আগামী দিনে ফোরজি প্রযুক্তির সেবা চালু করতে টেকনোলজি নিউট্রালিটির প্রয়োজন, যাকে প্রযুক্তিনিরপেক্ষতা বলা যেতে পারে। এটি এমন যে, কোন ব্যান্ডের তরঙ্গ অপারেটররা কোন প্রযুক্তির জন্য ব্যবহার করছে, সরকার তা নির্ধারণ করবে না। অপারেটরই তার প্রয়োজন ও উপযোগিতা অনুযায়ী এ তরঙ্গ ব্যবহার করে ভিন্ন ভিন্ন প্রযুক্তির সেবা দেবে। এটি করা হলে অপারেটররা বাজারমূল্যে প্রয়োজনীয় তরঙ্গ কিনবে, আর সে তরঙ্গ ব্যবহার করে গ্রাহকের কাছে সেবা পৌঁছে দেবে। প্রযুক্তিনিরপেক্ষতার এ সুযোগ তরঙ্গের মতো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতের পাশাপাশি গ্রাহক পর্যায়ে উন্নততর সেবা নিশ্চিত করবে।
অন্যদিকে ফোরজি চালুর ক্ষেত্রে গ্রাহক চাহিদা তৈরির বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। থ্রিজি চালু হয়েছে, প্রয়োজন অনুযায়ী ফোরজিও চালু হবে। এখনই এটি চালু করা সুবিবেচনাপ্রসূত কিনা, তাও দেখতে হবে। সেলফোন সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপকরণ হ্যান্ডসেট। বর্তমানে সারা দেশে হয়তো ২-৩ শতাংশ মানুষের কাছে ফোরজি প্রযুক্তিতে ব্যবহার করা যায়, এমন হ্যান্ডসেট রয়েছে। এ অবস্থায় সারা দেশে ফোরজি নেটওয়ার্ক গড়ে তুললেও তা ব্যবহার করতে পারবে মাত্র ২-৩ শতাংশ মানুষ। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ ধরনের বিনিয়োগ মোটেও টেকসই নয়।
দেশে টেলিকম খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো তুলনামূলক অনেক বেশি স্বচ্ছভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছে। এর অন্যতম কারণ হলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে দিয়ে কাজ করতে হয় এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এছাড়া অনেক বেশি মানুষের সঙ্গে সংযুক্ত খাতটি। এসব মানুষের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততাও টেলিকম খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশি। এ সম্পৃক্ততার কারণেই নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি সেভাবে গড়ে উঠেছে।
সিম নিবন্ধনে বায়োমেট্রিক ব্যবস্থা চালুর যে উদ্যোগ চলছে, তা অনেক দিন থেকেই বলে আসছে গ্রামীণফোন। নিজেদের প্রয়োজনেই অপারেটরদের এটি চালু করতে হবে। কারণ যথাযথভাবে নিবন্ধিত না থাকায় যে জটিলতা রয়েছে, তার দায় নিতে হচ্ছে অপারেটরদেরই।
মোবাইল নম্বর পোর্টেবিলিটি (এমএনপি) চালুর যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তা সেবার মান নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখবে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারিগরি বিভিন্ন দিক বিবেচনায় নিয়ে এমএনপি চালু করা প্রয়োজন। এছাড়া সিম নিবন্ধনের বর্তমান প্রক্রিয়া সম্পন্নের পর এটি চালু করা হলে নানা জটিলতা এড়ানো সম্ভব হবে।
টেলিযোগাযোগ খাতের বিকাশে অন্যতম একটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে উচ্চ করহার। দেশে তো বটেই, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় এ খাতে বিদ্যমান কর অত্যন্ত বেশি। সেলফোন অপারেটরদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ প্রায়ই করা হয়, তা হলো কল ড্রপ। বাস্তবে কল ড্রপের হার শূন্যে নামিয়ে আনা সম্ভব নয়। প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণেই তা সম্ভব নয়। গ্রামীণফোনের বর্তমান কল ড্রপের হার ১ শতাংশ। এটি বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের অপারেটরদের তুলনায় কম। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও কল ড্রপের হার অনেক বেশি। ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) মানদণ্ড অনুযায়ী কল ড্রপের আদর্শ মান সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ। দেশেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ মানদণ্ড অনুসরণ করছে।
Source