খবরের শিরোনামঃ ফোনে আড়িপাতা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা

খবরের তারিখঃ ২০১৫-১১-১৭

-আবরার মাসুদ
আন্তর্জাতিক আইনে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার যে অধিকার দেয়া হয়েছে, পৃথিবীর দেশে দেশে সেই অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে অভ্যন্তরীণ আইনে তার অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে। কিন্তু ব্যক্তিগত গোপনীয়তার এই অধিকার নিরঙ্কুশ নয়। জনস্বার্থ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তাজনিত বৃহত্তর স্বার্থে ব্যক্তির নানা গোপন বিষয়েও নজরদারি আইনসিদ্ধ হতে পারে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে প্রাইভেসি রাইটস বা ব্যক্তির তথ্য সুরক্ষা ও গোপনীয়তা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনের দ্বারা আরোপিত বিধিনিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের যোগাযোগের উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকবে। জাতিসংঘের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ঘোষণার ১৭ নাম্বার ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তির নিজস্ব গোপনীয়, পরিবার, বাড়ি ও অনুরূপ বিষয়কে অযৌক্তিক বা বেআইনি হস্তক্ষেপের লক্ষ্যবস্তু বানানো যাবে না, তেমনি তার সুনাম ও সম্মানের ওপর বেআইনি আঘাত করা যাবে না। এছাড়াও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণা (অনুচ্ছেদ ১২), জাতিসংঘের কনভেনশন অন মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স (অনুচ্ছেদ ১৪) এবং শিশু অধিকার সনদ (অনুচ্ছেদ ১৬)-তে 'ব্যক্তিগত গোপনীয়তা'কে অধিকার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। বাংলাদেশ তথ্য অধিকার আইনেও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারের বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। তবে এখানে লক্ষণীয় যে গোপনীয়তার এই অধিকারের ওপর আইনের মাধ্যমে বিধি-নিষেধ আরোপ করার সুযোগ দেয়া হয়েছে রাষ্ট্রকে। জনস্বার্থ, রাষ্ট্রের সংহতি প্রভৃতি কারণে রাষ্ট্রকে এই সুযোগ দেয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে। আমাদের দেশেও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন, ২০০১-এর মাধ্যমে সরকারকে প্রয়োজনে আড়িপাতার বৈধতা দেয়া হয়েছে। আড়িপাতা আইনে যা আছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন, ২০০১-এ সরকারকে টেলিফোনে আড়িপাতার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে এ আইনের ৯৭ক ধারায় বলা হয়েছে, 'এই আইন বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যা কিছুই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে যে কোনো টেলিযোগাযোগ সেবা ব্যবহারকারীর পাঠানো বার্তা ও কথোপকথন প্রতিহত, রেকর্ড ধারণ বা তৎসম্পর্কিত তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য সরকার সময় সময় নির্ধারিত সময়ের জন্য গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোনো কর্মকর্তাকে ক্ষমতা দিতে পারবে এবং এ কার্যক্রমে সার্বিক সহায়তা প্রদানের জন্য টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানকারীকে নির্দেশ দিতে পারবে এবং পরিচালনাকারী ওই নির্দেশ পালন করতে বাধ্য থাকবে।' এই আইনে 'সরকার' বলতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বোঝানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমেই এ ধারা প্রযোজ্য হবে। সরকারের তৎপরতা বাংলাদেশে ল্যান্ডফোন, মোবাইল ও তারবিহীন পিএসটিএনসহ সব ধরনের টেলিফোন গ্রাহকের কথোপকথন, ভয়েস ও ডাটা রেকর্ড করা হচ্ছে। তবে তা সংরক্ষিত থাকছে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। সরকারের নির্দেশে ৬টি মোবাইল অপারেটর, বিটিসিএল ও ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জগুলো (আইসিএক্স) বাধ্যতামূলকভাবে এ রেকর্ড করছে। আন্তর্জাতিক কলের আদান-প্রদান রেকর্ড করছে আইসিএক্স। অভ্যন্তরীণ কলগুলো রেকর্ড করছে সংশ্লিষ্ট অপারেটর। একই সঙ্গে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাও প্রতিদিন গড়ে ৫ থেকে ৭ হাজার টেলিফোনের কথোপকথন ও ডাটা রেকর্ড করছে। এজন্য তাদের নিজস্ব মেশিনপত্র ও সরঞ্জমাদি রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে এসব টেলিফোনে আড়িপাতছে গোয়েন্দারা। এজন্য একটি গোয়েন্দা সংস্থার কার্যালয়ে সাময়িকভাবে স্থাপন করা হয়েছে আড়িপাতার যন্ত্রপাতি। সেখানে পুলিশ, এসবি, এনএসআই আলাদা কক্ষে মুঠোফোন ও টিঅ্যান্ডটি ফোনে আড়িপাতছে। আড়িপাতার এই প্রক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করতে আলাদা দপ্তরও করা হয়েছে। সরকারের প্রয়োজনে রেকর্ডকৃত এসব ডকুমেন্ট থেকে সংশ্লিষ্টদের তথ্য প্রতিনিয়ত যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এসব ডকুমেন্টের সঙ্গে সরকারবিরোধী কোনো কর্মকা-, বোমাবাজি সংক্রান্ত কোনো কথা, জঙ্গি সংগঠন ও আন্তর্জাতিক পাচারকারী ও চোরাকারবারির সঙ্গে সম্পর্ক আছে কিনা তা খুঁজে দেখা হচ্ছে। এছাড়া কথোপকথন ও এসএমএসগুলোতে অপহরণ, চাঁদাবাজি ও খুনের পরিকল্পনার সঙ্গে কারও কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সরকারি কর্তৃত্ব ছাড়া আড়িপাতা দ-নীয় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইনে কেবল সরকারকেই জনস্বার্থে আড়িপাতার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সরকারের অনুমতি বা কর্তৃত্ব ছাড়া এ ধরনের কাজ করলে সেটি বেআইনি এবং দ-নীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। টেলিফোনে আড়িপাতার দ- সংক্রান্ত ৭১ ধারায় বলা হয়েছে, ব্যক্তি যদি অপর দুজন ব্যক্তির টেলিফোন আলাপে ইচ্ছাকৃতভাবে আড়ি পাতেন তাহলে প্রথমোক্ত ব্যক্তির এই কাজ হবে একটি অপরাধ এবং তার জন্য তিনি অনধিক ৬ মাস কারাদ-ে বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-িত হবেন। ২০০৬ সালে এ ধারায় সংশোধনী এনে এর সঙ্গে অপর একটি প্যারা জুড়ে দিয়ে বলা হয়েছে, 'তবে শর্ত থাকে যে, ধারা ৯৭ক-এর অধীন সরকার হতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত গোয়েন্দা সংস্থা, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্তকারী সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোনো কর্মকর্তার ক্ষেত্রে এই ধারার বিধান প্রযোজ্য হবে না।' অর্থাৎ সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে সংস্থা বা যে কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেবে সে সংস্থা বা সে ব্যক্তি টেলিফোনে আড়িপাততে পারবেন। আড়িপাতা আইনের প্রয়োগ-অপপ্রয়োগ বাংলালিকস নামের একটি ওয়েবসাইটে মাঝেমধ্যেই তুলে ধরা হচ্ছে নানা ধরনের টেলিফোন সংলাপ। বিভিন্ন রাজনীতিক ও সেলিব্রেটিদের টেলিসংলাপ ফাঁস করা হচ্ছে, যা আইনের চোখে গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বিষয়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি। টেলিযোগাযোগ আইন বিশেষজ্ঞ তানজীব-উল আলম একটি জাতীয় দৈনিকে এ ব্যাপারে তার অভিমত প্রকাশ করে বলেন, বাংলালিকস বা এ ধরনের সাইটগুলো যা করছে তা শতভাগ ব্যক্তিগত গোপনীয়তার লঙ্ঘন এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইনে অপরাধ। তারা এসব অডিও কোথায় পাচ্ছে, সে বিষয়ে অনুসন্ধান প্রয়োজন। আড়িপাতার মাধ্যমে অন্যের টেলিফোন কথোপকথন রেকর্ড করার অধিকার সংশ্লিষ্ট সংস্থা ছাড়া অন্য কারো সুযোগ নেই। আড়িপাতার বিষয়টির অপপ্রয়োগ নিয়ে চিন্তিত আইনজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মীরা। তাদের মতে, অন্যায়ভাবে কোনো ব্যক্তিগত বিষয়ে গোপনে অনুপ্রবেশ বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আড়িপাতা গ্রহণযোগ্য নয়। একটি জাতীয় দৈনিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান জানান, আড়িপাতার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধিমালা থাকা উচিত। কখন কার টেলিফোনে আড়িপাতা হবে, সে সিদ্ধান্ত দেয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ থাকতে হবে এবং পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রিতভাবে হতে হবে। এদিকে টেলিফোনে আড়িপাতা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ পৃথক দপ্তর করা হলেও তা এখনো চালু হয়নি। ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) নামে নতুন এ সংস্থাটি এখনও যাত্রা শুরু করতে পারেনি। ইতোমধ্যে এ দপ্তরের পদ সৃষ্টিসহ নিয়োগবিধি প্রণয়ন চূড়ান্ত হয়েছে। দেশে দেশে আড়িপাতা আড়িপাতার বিষয়টি নিয়ে বিশ্বব্যাপীও বিতর্ক রয়েছে। ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি জৈল সিং রাষ্ট্রপতি ভবনের টেলিফোনে আড়িপাতার জন্য রাজীব গান্ধী সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন। ১৯৯০ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথাবার্তা যখন চলছিল, সেই সময় চন্দ্রশেখরের টেলিফোনে আড়িপাতার অভিযোগ উঠেছিল। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নামে পরিচিত টেলিফোনে আড়িপাতার ঘটনায় ১৯৭৪ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বিদায় নিতে হয়েছিল। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো রয়েছে। একটি বিশেষ আদালতের অনুমতি ছাড়া সেখানে আড়িপাতা আইনত নিষিদ্ধ। এছাড়া রয়েছে সিনেটরদের নিয়ে গঠিত সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটি। যুক্তরাষ্ট্রে যেসব বিতর্কিত আইনের ধারায় নাগরিকদের ফোনে আড়িপাতা ও তথ্য সংগ্রহের ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল, তার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে চলতি বছরের মে মাসে। মার্কিন সিনেটে এ ব্যাপারে নতুন করে মতৈক্য না হওয়ায় আড়িপাতাসংক্রান্ত আইনের মেয়াদ নবায়ন সম্ভব হয়নি। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রে সন্ত্রাসী হামলার পর জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থাকে (এনএসএ) আবারো কোনো সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলা এড়াতে ফোনে আড়িপাততে অনুমতি দিয়েছিল কংগ্রেস। প্যাট্রিয়ট অ্যাক্ট নামে পরিচিত ওই আইনের ২১৫ ধারাসহ গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ধারার মেয়াদ ৩১ মে শেষ হয়ে যায়। ফলে আপাতত মার্কিন নাগরিকদের ফোনে আড়িপাতা বন্ধ রয়েছে।

Source