-নিজস্ব প্রতিবেদক:
ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেছেন, তিন-চতুর্থাংশ নারী সাইবার নিপীড়নের শিকার। তবে এঁদের মধ্যে মাত্র ২৬ শতাংশ অভিযোগ করেন, অন্যরা সামাজিকতার ভয়ে অভিযোগই করছেন না। জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বরা মারাত্মক হুমকির মধ্যে আছেন। গ্রামাঞ্চলের নারীরাও এ ধরনের নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না। আগামী দু-তিন বছরের মধ্যেই এ ধরনের সহিংসতা গ্লোবাল থ্রেট হিসেবে ব্যাপক হারে দেখা দেবে।
তারানা হালিম বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), র্যাব, পুলিশ, সিআইডিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সাইবার অপরাধ নিয়ে নিজের মতো করে কাজ করছে। কাজগুলো সমন্বিতভাবে হতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে নারী-পুরুষ সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি এবং সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
গতকাল মঙ্গলবার ‘নারী নির্যাতনে তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার: প্রতিকারের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রতিমন্ত্রী এসব কথা বলেন। প্রথম আলো ও ব্র্যাক যৌথভাবে এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
বক্তব্যে তারানা হালিম বিটিআরসির চলতি বছরের এক পরিসংখ্যান উল্লেখ করে বলেন, বিটিআরসিতে ২২০টি অভিযোগের মধ্যে ৬০ শতাংশই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক-সংক্রান্ত। কিছু অভিযোগ ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আমলে নিলেও বেশ কিছু অভিযোগ ‘আপত্তিজনক নয়’ বলে আমলে নিচ্ছে না। কিন্তু দেশীয় প্রেক্ষাপটে অবশ্যই সেসব অভিযোগ আপত্তিজনক।
তারানা হালিম জানান, শিগগিরই সরকার ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি করবে। এ ছাড়া সরকার ইন্টারনেট নিরাপত্তার জন্য বিশেষ প্রযুক্তি বা সফটওয়্যার আনতে যাচ্ছে। তবে যন্ত্রপাতি বা প্রযুক্তি সমস্যার সমাধান করতে পারবে না, সমস্যা সমাধানে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন তিনি।
ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি কর্মসূচির পরিচালক শীপা হাফিজা ফেসবুকে বন্ধু হওয়ার মাধ্যমে প্রতারণা করার একটি উদাহরণ উল্লেখ করে বলেন, ফেসবুকে এক ছেলে এক মেয়েকে বন্ধু হওয়ার আহ্বান জানায়। মেয়েটি বন্ধু হিসেবে তা অ্যাকসেপ্ট করে। কয়েক দিন পরে ছেলেটি বলে, সে মোটরবাইক কিনতে যাবে, মেয়েটিকে সঙ্গে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। মেয়েটি শোরুমে গেলে মেয়েটিকে একটি মোটরবাইকের ওপর বসিয়ে ছেলেটি আরেকটি বাইক চালিয়ে দেখার কথা বলে চলে যায়। পরে মেয়েটির পরিবার মেয়েটিকে শোরুম থেকে উদ্ধার করে।
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের উপসচিব মাহবুবা পান্না সচেতনতা তৈরির বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে বলেন, মেয়েরা ফেসবুক বা ই-মেইলের পাসওয়ার্ড ছেলেবন্ধুকে দিয়ে দিচ্ছে। মেয়েদের বুঝতে হবে, পাসওয়ার্ড হচ্ছে মেয়েদের ব্যক্তিগত পোশাকের মতো, যা বাইরে প্রকাশ করতে নেই। এ ছাড়া কোনো একটি ঘটনা ঘটে গেলে অনেক মেয়ে আত্মহত্যা করছে। মেয়েদের মনে রাখতে হবে যে সাইবার অপরাধের জন্য তারা দায়ী নয়, যে করেছে সে দোষী।
প্রথম আলো কার্যালয়ে গতকাল প্রথম আলো ও ব্র্যাকের যৌথ আয়োজনে ‘নারী নির্যাতনে তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার: প্রতিকারের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা l প্রথম আলোঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক তথ্য কমিশনার সাদেকা হালিম সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সুশীল সমাজ ও প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন। কেননা, অপরাধীদের ধরার পর অমুক বা তমুক ভাইয়ের ভাগিনা বা অন্য পরিচয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয় অনেক সময়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক সুরাইয়া পারভীন জানালেন, তাঁরা সাইবার অপরাধ রোধে কাজ করেন। সাইবার অপরাধের পেছনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিভাবকদের অসচেতনতা দায়ী উল্লেখ করে তিনি বলেন, আধুনিক প্রযুক্তি হঠাৎ করে তরুণ প্রজন্মের হাতে চলে এসেছে। অথচ এখন পর্যন্ত অনেক অভিভাবক এই প্রযুক্তি সম্পর্কে তেমন একটা জানেন না। তাই তাঁরা ছেলেমেয়েকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। এ ছাড়া সাইবার অপরাধ দমনে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি ‘বোধের জায়গায়’ পরিবর্তন আনতে হবে।
তথ্যপ্রযুক্তি আইন বিশেষজ্ঞ তানজীব উল আলম বলেন, পুরুষেরা তথ্যপ্রযুক্তিকে ‘পাওয়ার ডিভাইস’ বা শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। তারা ধরেই নেয় যে এ ধরনের অপরাধে কোনো শাস্তি হবে না। অথচ দণ্ডবিধি, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন, আইসিটি অ্যাক্টসহ বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে সাইবার অপরাধের প্রতিকার পাওয়া সম্ভব। তবে আইন প্রয়োগে দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। বর্তমানে সরকার সাইবার নিরাপত্তা আইনের যে খসড়া করেছে, তা যাতে অন্যান্য আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এবং অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী সাজার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়, সেদিকে নজর দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
দোহাটেকের চেয়ারম্যান লুনা সামসুদ্দোহা বলেন, জাতিসংঘের ২০১৫-পরবর্তী টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় নারীরা যাতে বেশি করে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারেন, সে বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নারীরা যাতে হয়রানির শিকার না হন, সে জন্য প্রতিরোধের বিষয়টিতেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে।
নারীর ক্ষমতায়নে মায়া ডটকম ডট বিডির প্রধান (কনটেন্ট অ্যান্ড কমিউনিকেশনস) শাহানা সিদ্দিকী জানালেন, গত ফেব্রুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৩৫ হাজার প্রশ্নের মাধ্যমে নারীরা বিভিন্ন জিনিস সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। অনেকগুলো গল্প প্রায় একই রকম। একজনকে ভালোবাসার পর ওই ছেলেকে নিজের ছবি দেয়। তারপর ফটোশপে ওই ছবিকে পাল্টে ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয় ওই প্রেমিক। মায়া ডটকম এর প্রতিকারে সব সময় সহায়তা দেয়। যোগাযোগ: www.maya.com.bd।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ‘এ টু আই’ কর্মসূচির স্থানীয় উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ সুপর্ণা রায় বলেন, ইউনিয়ন ও পৌরসভা তথ্য উন্নয়ন কেন্দ্রে কর্মরত নারী উদ্যোক্তারা বিভিন্ন কারণে ঝরে পড়ছেন। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে নারীদের মধ্যে সচেতনতাও কম। সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।
উপপুলিশ কমিশনার (উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন) ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, সাইবার হয়রানির শিকার কোনো নারী সহায়তা চাইতে এলে গোপনীয়তা বজায় রেখে ওই নারীকে সার্বিক সহায়তা দেওয়া হয়। নারী পুলিশের সঙ্গে পাঠিয়ে থানায় মামলা দায়েরসহ অন্যান্য সহযোগিতা করা হয়।
ফরিদা ইয়াসমিন অপরাধের শিকার নারীদের পরিবারসহ সবাই যাতে মানসিকভাবে সহায়তা দেয়, সে আহ্বান জানান।
টেকম্যানিয়া ঢাকার প্রধান নির্বাহী তাসলিমা মিজি ফেসবুকে দল তৈরি করে সাইবার হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার নারীর পাশে দাঁড়ানো যায় বলে উল্লেখ করেন। অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের সহায়তা ওই নারীকে আত্মহত্যার পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে।
Source