খবরের শিরোনামঃ নারী নির্যাতনের আধুনিক হাতিয়ার সাইবার ক্রাইম

খবরের তারিখঃ ২০১৫-১১-২৬

-আসলাম রহমান :
একটি জাতীয় দৈনিকের নারী সংবাদকর্মী মান্নাত (ছদ্মনাম)। ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করে পা রাখেন নতুন জীবনে। কিন্তু মেহেদির রঙ না মুছতেই সাইবার ক্রাইমের শিকার হয়ে উলট-পালট হয়ে যায় তার সাজানো সংসার। মান্নাতেরই এক পুুরনো মিডিয়া সহকর্মী তার স্বামীর মোবাইল নম্বরে স্ত্রীর চরিত্র নিয়ে অশ্লীল ও অশ্রাব্য ম্যাসেজ পাঠাতে থাকে। অশান্তির ঝড় ওঠে মান্নাতের জীবনে। স্বামীর সঙ্গে অবিশ্বাসের দোলাচল, দ্ব›দ্ব-সংঘাত বাড়তে থাকে। চরিত্রে কালিমা লেপন করে অব্যাহত ম্যাসেজ পাঠাতে থাকলে বিষিয়ে ওঠে মান্নাতের জীবন। বাড়তে থাকে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। কিন্তু মান্নাতের প্রতারক সহকর্মী এখানেই থেমে থাকেনি। সে মান্নাতের ফেসবুক আইডি থেকে তার স্বামীর ছবি নিয়ে তার নাম ব্যবহার করে একটি ফেক আইডি খোলে। এর পর সেই ফেক আইডিতে স্ত্রীর চরিত্র নিয়ে নোংরা ও অশ্রাব্য কমেন্টস লিখে আপলোড করতে থাকে। বিষয়টি এ রকম- ‘আমার স্ত্রী নষ্ট চরিত্রের, রাত-বিরাত বিভিন্ন ছেলের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়, মিডিয়ার অনেক ছেলের সঙ্গে তার অনৈতিক সম্পর্ক আছে, তার সঙ্গে সংসার করতে চাই না’ ইত্যাদি। একই সঙ্গে বিভিন্ন সময় মিডিয়া কর্মীদের সঙ্গে তোলা সাধারণ ছবি সুপার ইমপোজ করে অশ্লীলভাবে আপলোড করতে থাকে। এতে আরো দুর্বিষহ হয়ে ওঠে মান্নাতের জীবন। দূরত্ব বাড়ে স্বামীর সঙ্গে। ভালোবাসা নয়- জীবন হয়ে ওঠে যন্ত্রণাময়, নরকতুল্য। এ নরক যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে মান্নাত কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়। পরে বিষয়টি গড়ায় থানা-পুলিশে। রাজধানীর খিলগাঁও থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন মান্নাত। এর পরও থেমে নেই প্রতারক সহকর্মীর সাইবার ক্রাইম অস্ত্র। এভাবে প্রতিনিয়তই সাইবার ক্রাইমের ফাঁদে পড়ে উলট-পালট হয়ে যাচ্ছে বহু নারীর জীবন। মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সারা জীবনের জন্য। অনেকে বেছে নেন আত্মহত্যার পথ। আবার অনেকেই বেঁচে আছেন দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউবের অপব্যবহারে হুমকির মুখে পড়েছে নারীর ব্যক্তি জীবন। অনেক সময় দেখা যায়, সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র ধর্ষণ করে তা ক্যামেরায় ধারণ করে। অনেক ক্ষেত্রে তারা ওই ছবি বা ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়। কখনো কখনো ধর্ষিতার পরিবারের কাছে দাবি করা হয় বড় অঙ্কের টাকা। হুমকি দেয়া হয় টাকা না দিলে ছবি বা ভিডিও ছড়িয়ে দেয়া হবে অনলাইনে। এসব ঘটনায় অনেক নারীই আত্মহননের পথ বেছে নেন। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রওশন আরা বলেন, সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে এখনই জরুরি পদক্ষেপ নেয়া উচিত। আর সেটি না হলে অচিরেই বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। সিআইডি সূত্র জানায়, চলতি বছরের গত ১০ মাসে রাজধানীসহ সারা দেশ থেকে সাইবার ক্রাইম সংক্রান্ত ১৭৪টি মামলা সিআইডিতে এসেছে তদন্তের জন্য। যার অধিকাংশেরই ভিকটিম নারী। অন্যদিকে সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ এবং দমনে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ (আইসিটি) গঠিত ‘সাইবার হেল্পলাইনে’ (০১৭৬৬৬৭৮৮৮৮) গড়ে প্রতিদিন ৩০-৪০টি অভিযোগ আসছে। সে হিসেবে মাসে প্রায় ১ হাজার অভিযোগ আসছে। যার ৮৫ শতাংশ ভিকটিমই নারী। সাইবার হেল্পলাইনের আইন উপদেষ্টা এডভোকেট নাজনীন গতকাল বুধবার ভোরের কাগজকে এসব তথ্য জানিয়ে বলেন, বেশির ভাগ অভিযোগই ফেসবুক, ই-মেইল ও ইউটিউবসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইট কেন্দ্রিক। তিনি বলেন, যদি কারো ফেসবুক আইডি হ্যাক হয় তাহলে ভিকটিমকে প্রশ্ন করে জানার চেষ্টা করি কীভাবে হ্যাক হলো, এর পর সমাধান দেয়া হয়। আর ফেক আইডি হলে ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে বন্ধ করে দিতে বলি। এ জন্য নির্দিষ্ট সময় প্রয়োজন। আর যদি কেউ আইনগত সহায়তা চায় সে ক্ষেত্রে কীভাবে জিডি বা মামলা করতে হবে সেটা বলে দেয়া হয়। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার ক্রাইম শাখার সহকারী কমিশনার নাজমুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, বর্তমানে অপরাধ জগতের বড় একটা অংশজুড়ে আছে সাইবার ক্রাইম। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ বিষয়ে খুবই সজাগ। সাইবার ক্রাইমের বর্তমান অবস্থা হলো- সোস্যাল নেটওয়ার্ক। এখানে দুই ধরনের ক্রাইম হয়। একটা হলো সাইবার টেরোরিজম, বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনগুলো সরকারবিরোধী প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে। অন্যটি হলো ব্যক্তিগত সমস্যা। দেশে এবং দেশের বাইরে থেকে সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষকে হাজারো সমস্যায় পড়তে হয়। এগুলো থেকে সমাধান পেতে হলে মানুষকে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। সাইবার ক্রাইম রোধে সিআইডি ও ডিবিতে এ বিষয়ে আমাদের এক্সপার্ট রয়েছে। আমরা সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে এটাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছি। তবে প্রতিনিয়তই নিত্যনতুন প্রযুক্তি আসছে, নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এগুলো সামাল দিতে আমাদের কষ্ট হয়। সাইবার ক্রাইমের শিকার হওয়া অনেকে হারিয়ে ফেলেছেন তাদের স্বাভাবিক জীবন। মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সারা জীবনের জন্য। দেশের একটি প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের মেয়ে রিতা (ছদ্মনাম)। ছয় বছর আগে তার সখ্য গড়ে উঠেছিল এক সহপাঠীর সঙ্গে। ধীরে ধীরে সম্পর্ক গড়ায় প্রেমে। একদিন বাড়িতে মা-বাবা না থাকায় রিতা ছেলেটিকে আসতে বলে। ছেলেটি বাড়িতে এলে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। আর ওই ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের কিছু ছবি ক্যামেরায় ধারণ করে রাখে রিতার প্রেমিক। এর পর থেকে তারা সুযোগ পেলেই মিলিত হতো। এভাবে ৬ বছর তাদের ভালোই কাটে। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় তখনই যখন উভয়ের মাঝে মনোমালিন্য দেখা দেয়। একটা সময় পর রিতা তার প্রেমিককে আর সহ্য করতে পারছিলেন না। মুক্ত হতে চাচ্ছিলেন পুরনো সম্পর্ক থেকে। কিন্তু রিতার প্রেমিক এতে কোনোভাবেই রাজি নয়। সে ব্যবহার করে সাইবার অস্ত্র। রিতাকে হুমকি দেয় ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে তোলা ছবি অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়ার। ছবিগুলো ফেসবুকে ছড়িয়েও দেয়। এ ব্যাপারে মেয়ের বাবা বাদী হয়ে গত ২১ মে শাহবাগ থানায় মামলা করেছেন (মামলা নম্বর ২২)। ঢাকার একটি নামী একটি মেডিকেল কলেজের এক ছাত্রীর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে তারই এক সহপাঠীর সঙ্গে। ধীরে ধীরে তারা শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। কোনো এক দুর্বল মুহ‚র্তের দৃশ্য ভিডিও করে রাখে তার প্রেমিক। এভাবে দিন যায় বছর আসে। মেয়েটি ডাক্তারি পাস করে। আর তার প্রেমিক মেডিকেল কলেজে পড়াশুনা বাদ দিয়ে সাধারণ কোনো কলেজ থেকে ডিগ্রি নেয়। এদিকে ডাক্তারি পাস করার পর ভালো ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে তার জন্য। পরিবারও সায় দেয়। কিন্তু তার সাবেক প্রেমিক তাকে বিয়ে না করলে সেই দুর্বল মুহ‚র্তের ভিডিও অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। এতে বিপর্যস্ত হয়ে মেয়েটি ও তার পরিবার। লোকলজ্জা আর সামাজিক সম্মানের ভয়ে মামলা করতেও ভয় পাচ্ছে মেয়েটি। এমনই আরেক ঘটনার শিকার হয়েছেন একজন নারী যিনি পেশায় ব্যারিস্টার। বিয়ের পরদিন থেকেই তার মোবাইল ফোনে একটি অচেনা নারীর কল আসতে থাকে। রিসিভ করলেই অপর পাশের নারী কণ্ঠটি তার স্বামী সম্পর্কে বিভিন্ন বাজে কথা বলতে থাকেন। জানান তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পুরনো প্রেমের সম্পর্কের কথা। তাদের সম্পর্কের গভীরতার কথা। সম্পর্ক চলাকালে তারা কোথায় কোথায় গিয়েছেন এবং কি কি করেছেন তার বিস্তারিত বিবরণ দিতে থাকেন। তাকে ই-মেইলে পাঠাতে থাকেন তাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ও ভিডিও। এ রকম শুনতে শুনতে একপর্যায়ে ব্যারিস্টার মেয়েটি শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এমনকি এ কারণে তার অকাল গর্ভপাত হয়ে যায়। একপর্যায়ে যখন তার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন তিনি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার ক্রাইম শাখার শরণাপন্ন হন। ডিবি পুলিশ মোবাইল ফোন ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে ঐ নারীকে আটক করে। ডিবি সাইবার ক্রাইম শাখার সহকারী কমিশনার নাজমুল ইসলাম বলেন, ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়ে আমাদের আরো বেশি সচেতন হওয়া প্রয়োজন। আজ যার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রয়েছে কাল সেটি নাও থাকতে পারে। আর তাই ছবি তোলা বা ভিডিও আপলোডের সময় অনেক বেশিমাত্রায় সচেতনতা প্রয়োজন। অতিরিক্ত ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাবে মানুষের জীবনে দিন দিন অপসংস্কৃতি প্রভাব বিস্তার করছে। কিশোর-কিশোরীরা শিকার হচ্ছেন প্রতারণামূলক প্রেমের সম্পর্কের। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেক্স ওয়েবসাইটগুলো ব্রাউজিংয়ের ফলে তাদের মধ্যে হ্রাস পাচ্ছে নীতি-নৈতিকতা। যার ফলে তারা জড়িয়ে যাচ্ছে সাইবার ক্রাইমসহ নানা অপকর্মে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সাইবার ক্রাইমের বিষবাষ্প থেকে রক্ষায় পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ, রাষ্ট্র সবারই সচেতনতা জরুরি।

Source