-অন্যদৃষ্টি g জয়া ফারহানা
দালি’র ঘড়ির মতো থমকে গেছে তাদের সময়। স্থবির হয়ে যাওয়া এই মানুষের সংখ্যা কম নয় কিন্তু। প্রায় দু’কোটি। তালিকায় আছে সেই কন্যাশিশুটিও, যাকে মাত্র দু’-তিন বছর আগেও স্কুলে পৌঁছে দেয়ার সময় আঙুল ধরে রাস্তা পার করে দিতে হতো। আছে সদ্য শৈশব উত্তীর্ণ কিশোরটি, যাকে মুখে তুলে না খাইয়ে দিলে খেতেই পারতো না। না। তারা কেউ পরীক্ষায় অনাকাঙ্ক্ষিত খারাপ ফল করেনি। শরীরও অসুস্থ নয়। পরিবারের কেউ অসুস্থ? না, ঠিক তা নয়। কাছাকাছি সময়ে কোনো আর্থিক বিপর্যয়ের ঘটনাও ঘটেনি। অথচ প্রায় সপ্তাহখানেক হলো বাড়ির চিরপরিচিত পরিবেশটি উধাও। কারণ আর কিছু নয়। ওদের মননের ‘প্রাণভোমরা’টি নেই। ফেসবুক সংস্কৃতির তুরীয় বিকাশের দশকের সন্তান এরা। এরা নাকি ফেসবুক দিয়েই জগেক ব্যাখ্যা করতে শিখেছে। পৃথিবীর বহুদূরের মানুষটির সঙ্গে নৈকট্যের অনুভূতি মানে এদের কাছে ফেসবুক। ভার্চুয়াল এই সেপারেশনে তাদের মানসিক টানাপোড়েন সত্যি যারা ফেসবুকের সঙ্গে নেই, তারা বুঝবেন না। কত ছন্দে, কত কৌশলে, কত বর্ণে কত গন্ধে, কত রঙে, কত ছোঁয়াতেই না তারা ফেসবুককে চিনেছে। নিরূপায় এক ফেসবুকার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন এভাবে, আগে বন্ধুদের ঘন ঘন ‘চেকইন’কে কতই না গালমন্দ করেছি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি আগে অন্তত ‘চেকইনে’র মাধ্যমে পরিচিতজনদের জানার সুযোগ ছিল, ‘উধাও’ হওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে কোনো বন্ধু কোথায় ছিল, কার সঙ্গে ছিল। নিখোঁজ বন্ধুকে খুঁজে পাওয়া ছিল সহজ। এখন আর ‘চেকইন’ দেয়ার বা দেখার বালাই নেই। চাইলে স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কেউ ‘উধাও’ হতে পারে। বুঝতে পারছি ফেসবুক ব্যবহারকারী এক কোটি সত্তর লক্ষ সাবস্ক্রাইবার এখন ফেসবুকের অনুপস্থিতিতে অন্যরকম অস্তিত্বের সংকটে ভুগছেন।
ফেসবুক তাদের কাছে তথ্য বিনিময়ের মাধ্যম শুধু নয়, বরং ফেসবুকই তাদের পালা-পার্বণ, উত্সব। জুতা সেলাই থেকে চন্ডী পাঠ পর্যন্ত সবই তারা সম্পন্ন করে ফেসবুকের মাধ্যমে। ফেসবুকের ক্ষুধার সামনে জীবনের বাকি সব আয়োজন তুচ্ছ। তো এই নিখিল বঙ্গীয় ফেসবুক সংস্কৃতির উত্তুঙ্গ দিনে বিটিআরসি, টেলিযোগাযোগ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ত্রিমুখি ঢিলেঢালা আশ্বাসে কিছুতেই মিলেনিয়াম প্রজন্মের সংকট সংক্রান্ত এজেন্ডার সুরাহা হচ্ছে না। সন্দেহ নেই, মিলেনিয়াম প্রজন্মকে সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণের নিয়মতান্ত্রিক মাধ্যম ছিল ফেসবুক। ফেসবুক পাঠের মাধ্যমে মিলেনিয়াম প্রজন্মকে পাঠ করা গেছে সহজেই। পাঠ করা গেছে তাদের সাংস্কৃতিক মানচিত্র। পাওয়া গেছে তাদের ব্যক্তিগত মনের পাঠও। ঠিক যে কোনো লেখাই পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠার ঝোঁক সেখানে থাকে না। খুবই আটপৌরে কথন ভঙ্গিতে সবাই লেখেন এই মাধ্যমে। পাশাপাশি কনফারেন্স করে পড়াশোনা, প্রশ্নপত্র, পরীক্ষার রুটিন, নোটস... যাবতীয় অমীমাংসিত বিষয়েরও মোটামুটি হিল্লা হয়। বাংলাদেশে ফেসবুক সংস্কৃতি চালুর পর এই প্রথম বিচ্ছেদের কবলে পড়লো। সেই সঙ্গে ফেসবুকের ওপর লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণীর যে মনস্তাত্ত্বিক নির্ভরতা তৈরি হয়েছে, তাও মোটামুটি হুমকির মুখে পড়লো। ফেসবুক যাদের কাছে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’য়ের ইমেজ দেয়, এই বিরহ দশার চেয়ে অন্য আর যে কোনো দুর্দশা শ্রেয়তর তাদের কাছে।
হ্যাঁ ঠিক যে, জগত্ সংসারে হেন কোনো অবমাননাকর শব্দ নেই যা ফেসবুকীয় যুদ্ধে দেখা যায়নি। রকমারি গালিগালাজকে তারা রীতিমতো ব্র্যান্ডিং করেছে। কিন্তু শুধু গালিগালাজই ব্র্যান্ডিং হয়েছে ? না। বহু চিন্তা জাগানিয়া পর্যবেক্ষণও তো ছিল। ভার্চুয়াল সম্পর্কের বাইরে এতদিনে ভার্চুয়ালাতিরিক্ত সম্পর্কও তো তৈরি হয়েছে পরস্পরের সঙ্গে। লাইকের সূত্রে কখনো কখনো একজনের সঙ্গে অন্যজনের স্নিগ্ধ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। কোথাও একটুখানি মায়াও জড়িয়ে গেছে পারস্পরিক সম্পর্কগুলোতে। টেক্সটুয়াল সম্পর্কের বাইরে বিস্তর মানবীয় সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। প্রয়োজনে টেক্সটবন্দি মানুষগুলো সশরীরে ছুটে গেছে নানা ভূমিকায়। সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা মুমূর্ষুকে দুর্লভ গ্রুপের রক্ত দিয়ে বাঁচিয়েছে। কখনো বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছে (তাদের বিবেচনায়)। বিশ্বব্যাংক-এডিবি-ইউনোকল কমিশন ভোগীদের সব আয়োজন প্রতিহত করতে ঢাকা-বিবিয়ানা লংমার্চে অংশ নিয়েছে। সীমান্তে হত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। টিপাই মুখে বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদ করেছে। বিভিন্ন সময়ে আইএমএফ-এর পরামর্শে তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানিয়েছে। ‘গুড মুসলিম’, ‘ব্যাড মুসলিম’ ব্র্যান্ডিংয়ের প্রতিবাদ জানিয়েছে। সমাজের ঘটে যাওয়া বিভিন্ন দুর্ঘটনা-দুর্নীতির প্রামাণ্য দলিল হাজির করেছে। ‘অদম্য বাংলাদেশে’র পক্ষে ন্যায্যত দাঁড়িয়েছে। রাজন-রাকিব...সহ আরো বহুজনের জন্য শোকের অক্ষর উপচে পড়েছে টেক্সটে।
মোটকথা, বাতাসে বারুদের গন্ধ পেলেই তারা ছুটে এসছে রাজু ভাস্কর্যের সামনে। ফেসবুক বন্ধ থাকায় আউটসোর্সিং, ফেসবুক মার্কেটিং, অনলাইন ফ্রিল্যান্সার এবং অনলাইনভিত্তিক প্রফেশনাল ব্যবসায়ীরা এখন অপূরণীয় আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি। কয়েক হাজার অনলাইন ব্যবসা পড়েছে চূড়ান্ত সংকটে। কমেছে টেরাবাইট ব্যান্ডউইথ বিক্রি। ই-কমার্স সাইটের অর্ডার কমে গেছে উল্লেখযোগ্য হারে। মোদ্দাকথা, ই-কমার্সের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ীদের ব্যবসা পড়েছে সরাসরি হুমকির মুখে।
তবে, পরিচয় ও পেশার নির্মম এই সংকটে পতিত ফেসবুক ব্যবহারকারীরা বৃহত্তর স্বার্থে সাময়িক সমস্যা মেনে নেবেন নিশ্চয়ই। সঙ্গে এই আশাও থাকবে ফেসবুক শাসিত দুই কোটি ফেসবুকারের জীবনের অভিধানটিও যেন নীতি-নির্ধারণী মহল আমলে নেন।
Source