-মোস্তাফা জব্বার : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট।
ফেসবুক-ভাইবার হোয়াটস অ্যাপ ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এই নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে। এটি কোনোভাবেই আন্দাজ করা কঠিন যে এসব কবে খুলে দেয়া হবে। কি চরম অবস্থার জন্য এসব বন্ধ করা হয় এবং অবস্থার কি উন্নতি হলে এসব খুলে দেয়া হবে সেটি আর যারই হোক দেশের ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের জানা নেই। একইভাবে যারা এসব বন্ধ করেছেন তারা এটি জানেন কি যে তাদের বন্ধ করাটা বস্তুত একটি কাগুজে আদেশ এবং আমার মতো দুচারজন আইনমান্যকারী ছাড়া বন্ধের কোনো ছাপ কারো জীবনে সহজে চোখে পড়ে না। অবস্থাটি হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ যারা করেছেন তাদের অবস্থা উটপাখির মতো। তারা নিজেদের বালির নিচে লুকিয়ে ভাবছেন দুনিয়ার কেউ তাদের দেখছে না। আমরা জানি যে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির প্রেক্ষিতে সরকার এই নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এরই মাঝে ফাঁসিতো হয়েছেই এর আগে-পরে দুটি হরতালও হয়ে গেছে। পাকিস্তানের একাত্¥তা ঘোষণা, হাই কমিশনারকে তলব, কড়া প্রতিবাদ এসবও শেষ হয়েছে। ফাঁসির কোনো অবশিষ্টাংশও আছে বলে মনে হয় না। তবুও বহাল রয়েছে নিষেধাজ্ঞা।
জামায়াতের আলী আহসান মুজাহিদ ও বিএনপির সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি নিয়ে নাটক কম হয়নি। আপিল খারিজ হওয়ার পর প্রাণভিক্ষা নিয়েও নাটকীয়তার শেষ ছিল না। দুই যুদ্ধাপরাধীর পরিবারের পক্ষ থেকে কেবল গলার সুর উঁচু করা নয়, চরম দাম্ভিকতার প্রকাশও ঘটানো হয়েছে। জামায়াতের ডাকা দুটি হরতালে কোনো প্রভাব না থাকলেও যুদ্ধাপরাধীদের পিতৃভূমি পাকিস্তান পর্যন্ত আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলিয়েছে। তবে এবার তিনটি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট হয়েছে।
১. প্রথমত, এবার উপলব্ধি করা গেছে যে জামায়াত-বিএনপির কোমরে আর জোর নেই। হরতাল ডেকে সেটি পালনে জনগণকে বাধ্য করার জন্য ন্যূনতম পিকেটিং করার সাংগঠনিক ক্ষমতাও এদের আর নেই। ২. দুই যুদ্ধাপরাধী প্রাণভিক্ষা চাওয়ার মধ্য দিয়ে তাদের কৃতকর্মের দায় নিজেদের ঘাড়েই নিয়েছে। এর ফলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অবশিষ্টাংশ নিয়ে কোনো শঙ্কা বিরাজ করার সব কারণ তিরোহিত হয়েছে। ৩. পাকিস্তান প্রমাণ করেছে যে তারা একাত্তরের পরাজয়কে মানতে পারেনি। একাত্তরের পরাজয়ের বদলা নিতে ওরা এখনো বাংলাদেশে তাদের দালাল রেখে দিয়েছে। বিএনপি-জামায়াত যে পাকিস্তানের এজেন্ট সেটিও তারা এবার নিশ্চিত করেছে।
সম্ভবত তারপরও আমাদের সরকারের ভয় কাটেনি। তাদের শঙ্কার ঠিকানা এখন পথঘাট ছেড়ে ডিজিটাল মাধ্যমে ভর করেছে। এবার আমরা পথেঘাটে অস্ত্রধারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি তেমন দেখিনি। কিন্তু দেখলাম ফেসবুক, ভাইবার-হোয়াটস অ্যাপ ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাপ বন্ধ হতে। কিছুটা সময় পুরো দেশের ইন্টারনেটও বন্ধ ছিল।
তবে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করাটাই ডিজিটাল অপরাধ ঠেকানোর প্রকৃষ্ট পন্থা কিনা, সেটি নিয়ে। দেশের একটি প্রভাবশালী জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার ১৯ নভেম্বর ১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে প্রসঙ্গটি বেশ গুরুত্ব দিয়ে আলোচিত হয়েছে।
‘প্রযুক্তির জবাব প্রযুক্তি দিয়েই দিতে হবে’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রযুক্তি নির্ভর অপরাধ মোকাবেলা ও দমন প্রযুক্তি দিয়েই করতে হবে। অ্যাপস বন্ধ করে এর সমাধান সম্ভব নয়। নিরাপত্তার কথা বলে ফেসবুক, ভাইবার ও হোয়াটস অ্যাপের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং এ সংক্রান্ত বিভিন্ন অ্যাপস বন্ধ করা নিয়ে এমনটাই মত বিশেষজ্ঞদের।
….বিশেষজ্ঞদের মতে, বিনা মূল্যে মুঠোফোনে কথোপকথন, বার্তা ও ছবি-ভিডিও বিনিময়ে বিশ্বব্যাপী এমন শত শত অ্যাপস ব্যবহার হচ্ছে। তারা বলেন, কয়েকটি অ্যাপস বন্ধ করে কোনো কিছুর সত্যিকার সমাধান হবে না। কোনো অ্যাপস বন্ধ করলে প্রযুক্তির দুনিয়ায় কোনো না কোনোভাবে সেটা ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করা যায়। এ প্রসঙ্গে তারা কিছুদিন আগে বাংলাদেশে ফেসবুক বন্ধ করার উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, সে সময় প্রক্সি সার্ভার দিয়ে তরুণরা নানাভাবে ফেসবুক ব্যবহার করেছেন।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘এটা মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলার মতো অবস্থা।’ তিনি বলেন, ‘প্রযুক্তি নির্ভর অপরাধ প্রযুক্তি দিয়েই মোকাবেলা করতে হবে। কোনো অ্যাপস বন্ধ করা নয়; বরং সক্ষমতা বৃদ্ধিই সমাধান। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা রাষ্ট্রকে দুর্বল দেখতে পাই।’
মোস্তাফা জব্বার প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষম জনবল তৈরির ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, ‘এখন যে অবস্থা হয়েছে সেটা সরকারের অবহেলার জন্য হয়েছে। সরকারের মধ্যে প্রযুক্তিগত অপরাধ মোকাবেলার মতো পর্যাপ্ত প্রযুক্তি ও জনবল নেই। এখনই এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ আমরা সামাল দিতে পারব না।’
শ্রীলঙ্কাভিত্তিক টেলিযোগাযোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার সিনিয়র পলিসি ফেলো আবু সায়ীদ খান বলেন, ‘সন্ত্রাস দমনে সরকারের সদিচ্ছা সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন নেই। তবে অ্যাপস বন্ধ করে সন্ত্রাস কার্যকরভাবে বন্ধ করা গেছে এমন নজির আমরা দেখি না।’ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা এনটিএমসিকে শক্তিশালী করার ওপর জোর দেন তিনি। তার পরামর্শ হলো, জনবল ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার দিক থেকে এনটিএমসিকে এমনভাবে শক্তিশালী করতে হবে যাতে এর সক্ষমতা টেকসই হয়।
প্রকাশিত খবরটিতে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে। খবরে বলা হয়েছে, ‘নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুরোধে গত বুধবার ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ভাইবার, হোয়াটস অ্যাপ, লাইন, ট্যাংগো ও হ্যাংআউটসহ সামাজিক যোগাযোগের কয়েকটি মাধ্যম ও অ্যাপস বন্ধ করে দেয় সরকার। পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত এসব অ্যাপস বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এ পদক্ষেপ নিতে গিয়ে এক ঘণ্টারও বেশি সময় সারা দেশে বন্ধ ছিল ইন্টারনেট সেবা।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী শাহজাহান মাহমুদ বলেন, নিরাপত্তাজনিত কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুরোধে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো বন্ধের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এসব মাধ্যম বন্ধ করতে গিয়ে ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের ওপর কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে।…এ ব্যবস্থা নেয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেশ স্থিতিশীল করতেই ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার ও ভাইবার সাময়িক বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমার মনে হয়, যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে উৎকণ্ঠিত সরকার। দেশে তারা (বিএনপি-জামায়াত) অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ঘটাতে পারে, সে জন্য সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে। দু-চার দিন হয়তো বন্ধ থাকবে।’
এ প্রসঙ্গে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেন, ‘জনগণের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই ফেসবুক, ভাইবারের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো সাময়কিভাবে বন্ধ করা হযছে। একটি জীবনের মূল্যের চেয়ে বড় কিছু হতে পারে না। তাই এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করতে না পারার সাময়িক কষ্টটুকু জনগণকে মেনে নেয়ার অনুরোধ করছি।’
কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সামাজিক যোগাযোগের কয়েকটি মাধ্যম বন্ধের ইঙ্গিত দেন। নেদারল্যান্ডস থেকে ফিরে ৮ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে জঙ্গি অর্থায়নে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধরতে জটিলতার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ ডিজিটাল করেছি। এর শুভ ফলও যেমন আছে, খারাপ ফলও আছে। আমরা থ্রি-জি ও ফোর-জিতে চলে গেছি। এ কারণে জঙ্গিরা ইন্টারনেট, ভাইবার থেকে শুরু করে নানা ধরনের অ্যাপস ব্যবহার করে জঙ্গি কার্যক্রম চালাচ্ছে। সে জন্য আমাদের চিন্তাভাবনা আছে, যদি খুব বেশি ব্যবহার করে হয়তো একটা সময়ের জন্য বা কিছুদিনের জন্য বন্ধ করে দেব। এই লিংকগুলো (জঙ্গি অর্থায়নের সূত্র) যাতে ধরা যায়।’ ১১ নভেম্বর জাতীয় সংসদেও একই ধরনের বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের কোনোভাবে সহ্য করা হবে না। কিছুদিনের জন্য হলেও এটা বন্ধ করে সন্ত্রাসীদের যাতে ধরা যায় সে পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য এটা বন্ধ করে সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করে ধরা হবে।’
প্রসঙ্গত চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিএনপির অবরোধ কর্মসূচি চলার সময় ‘নিরাপত্তার’ কারণ দেখিয়ে ভাইবার, ট্যাংগো, হোয়াটস অ্যাপ, মাইপিপল ও লাইন নামের পাঁচটি অ্যাপসের সেবা বন্ধ করে দেয় সরকার। তখন বলা হয়েছিল, বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য এসব অ্যাপস ব্যবহার করতেন।
এরই মাঝে আমরা সরকারের নানা জনের কাছ থেকে আমরা নানা বক্তব্য পেয়েছি। তারা বারবার এ কথা বলার চেষ্টা করেছেন যে পরিস্থিতির উন্নতি হলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো খুলে দেয়া হবে। কিন্তু পরিস্থিতর খারাপ অবস্থাটা আর যাই হোক সাধারণ মানুষের কাছে দৃশ্যমান হচ্ছে না। পথেঘাটে জামায়াত-বিএনপি নেই। তাদের তেমন কোনো কর্মকাণ্ডও নেই। দেশের কোথাও কোন ধরনের নাশকতামূলক, সন্ত্রাসী, জঙ্গিবাদী বা অস্বাভাবিক অবস্থাও বিরাজ করে না।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা যোগাযোগে অ্যাপসগুলো বন্ধ করার পেছনে সরকারের পক্ষ থেকে যেসব কারণ উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো প্রধানত রাজনৈতিক। আমি নিজে মুজাহিদ ও সাকার ফাঁসির জন্য ইন্টারনেট পুরো বন্ধ করে দিলেও খুশি। যদি মাসের পর মাস ইন্টারনেট বন্ধ রেখে একাত্তরের ঘাতকদের ফাঁসিতে চড়ানো হয়, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয় এবং দেশটিকে একাত্তরের অঙ্গীকারে স্থাপন করা হয় তবে আমি সেটি মেনে নিতে চাই। আমি মনে করি, আমার জাতিসত্তা, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ইন্টারনেট ব্যবহার করার চাইতে বহুগুণ বেশি মূল্যবান। আমি জানি এসব অ্যাপ বন্ধ করার ফলে আমাদের ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক। এসব অ্যাপ কেবল সামাজিক যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত হয় না, বরং ফেসবুক এখন একটি বাণিজ্যিক প্লাটফরম। দেশের ই-কমার্স যেমন করে গড়ে উঠছে তেমনি করে এফ-কমার্সও দিনে দিনে বাড়ছে। হাজার হাজার তরুণ-তরুণী ফেসবুক ব্যবহার করে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে। ফেসবুক বন্ধ করে তাদের চরম ক্ষতির মুখোমুখি করা হয়েছে। তবে যেটি আমি বলেছি সেটি বিবেচনা করে আমরা কষ্টটা বা ক্ষতিটা হয়তো মেনে নেব।
গত ২৪ নভেম্বর ২০১৫ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে যে, অনলাইনে বেচাকেনা অর্ধেকে নেমে গেছে। কেইমুর ব্যবস্থাপক কাজী জুলকারনাইন ইসলাম জানিয়েছেন যে, তাদের সাইটে ভিজিটর কমে গেছে শতকরা ৫০ ভাগ। ফারিসা নামক ফেসবুক পেজের নাসরিন চৌধুরী জানিয়েছেন যে, ফেসবুক বন্ধ হওয়ার পর তার কোনো ব্যবসাই নেই। অন্যদিকে সফটওয়্যার সমিতি বেসিস মনে করে দৈনিক দুই কোটি টাকার ব্যবসা এখন চ্যালেঞ্জের মুখে।
কিন্তু প্রশ্নটি কেবলমাত্র ব্যবসা বাণিজ্য বা ঘাতকদের ফাঁসির জন্য নয়, প্রশ্নটি সামগ্রিকভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তার। দুচারটা ঘাতকের ফাঁসির সময় আমরা পুরো ইন্টারনেট বন্ধ করে বসে থাকলাম তাতে মনেও কষ্ট পাব না। কিন্তু প্রতিদিন যত ডিজিটাল অপরাধ হচ্ছে তার বিষয়ে আমরা কি করব? আমরা দেশটিকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে বদলে দেব এবং ডিজিটাল অপরাধ প্রসঙ্গে ভাবনা- সেটি হতে পারে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০০৮ সালে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করলেও ডিজিটাল অপরাধ মোকাবেলার জন্য তখন থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করিনি। শুরুতেই আইনগত সক্ষমতার কথাই বলি। ২০০৬ সালে প্রণীত আইসিটি অ্যাক্ট হচ্ছে ডিজিটাল সিগনেচার চালু করার আইন। সেই আইনটিকে ডিজিটাল অপরাধ দমনে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেই আইন পাসের ৯ বছর পর আমরা অনুভব করেছি যে, ডিজিটাল অপরাধ দমনের জন্য আলাদা আইন দরকার। সে জন্য এতদিনে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন নামে ডিজিটাল অপরাধ বিষয়ক একটি আইনের খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। এটি উল্লেখ করা দরকার যে প্রচলিত আইনগুলোও নতুন ধরনের অপরাধ বা ডিজিটাল অপরাধ দমনে সহায়ক নয়। আমাদের নিজেদের হিসাবে অন্তত ১৬৭টি আইন পরিবর্তন করে ডিজিটাল অপরাধ মোকাবেলা করার ব্যবস্থা করতে হবে। আইনগত এসব সংকট ছাড়াও যে কথাগুলো খুব গুরুত্ব দিয়ে বলা উচিত সেগুলো হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেসব অপরাধ করা হয় সেগুলো মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি সংগ্রহ করা হয়নি বা প্রয়োজনীয় জনবল গড়ে তোলা হয়নি। আমাদের আইনশৃক্সক্ষলা বাহিনীর মাঝে ডিজিটাল অপরাধ দমন করার জন্য বিশেষ টিম তেমন গুরুত্ব দিয়ে গঠন করা হয়নি। ডিজিটাল প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রক সংস্থাসমূহও বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। আমি বিশেষ করে বিটিআরসির অবহেলার কথা স্মরণ করতে পারি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে ডিজিটাল অপরাধকে ডিজিটাল প্রযুক্তি দিয়েই মোকাবেলা করতে হবে। দুনিয়াজোড়া ডিজিটাল অপরাধ হচ্ছে কিন্তু সেইসব অপরাধের ভয়ে কেউ ইন্টারনেট বন্ধ করছে না। আমাদের নীতিনির্ধারকরা এটি বুঝতে পারছেন না যে, আদেশ জারি করে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বন্ধ করা যায় না। যারা ভাবছেন ফেসবুক বন্ধ করে দেয়ার ফলেই বাংলাদেশের কেউ ফেসবুক ব্যবহার করতে পারছে না তারা আসলে বোকার স্বর্গে বাস করছেন। বাস্তবতা হলো, আমার জানা বহুজন ফেসবুক বন্ধ থাকার সময়ও ব্যবহার করছেন। তাদের আরো বোঝা দরকার যে, যাদের জন্য ফেসবুক বন্ধ করা হয়েছে তারা স্বাভাবিকভাবে সাধারণ মানুষ নন। তারা ফেসবুক-ভাইবার বা হোয়াটস অ্যাপ যেমন বিকল্প উপায়ে ব্যবহারে সক্ষম তেমনি তারা তাদের যোগাযোগের ক্ষেত্রে এনক্রিপশনও ব্যবহারে সক্ষম। তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রযুক্তি প্রয়োগ করতে হবে এবং যথাযথ জনবল তৈরি করে সেই জনবলকে প্রযুক্তিসক্ষম করতে হবে।
অন্যদিকে ডিজিটাল অপরাধ দমন করার জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এসব প্রযুক্তির সঙ্গে আমাদের নতুন প্রজন্মের মানুষরা যুক্ত। সে জন্য এসব প্রযুক্তি বিষয়ক সচেতনতা শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। আমি ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি অবধি বাধ্যতামূলকভাবে পাঠ্য করা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা বিষয়ক একটি অধ্যায় যুক্ত করার পক্ষে। একই সঙ্গে আমি মনে করি যে, শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসমূহে আয়োজিত শিক্ষক প্রশিক্ষণ কোর্স, জনপ্রশাসনের কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ কোর্সসহ সব ধরনের প্রশিক্ষণ কোর্সে ডিজিটাল নিরাপত্তা পাঠ্য বিষয় হওয়া উচিত।
গত ১৯ নভেম্বর ১৫ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘সরকার সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে জনগণের সহযোগিতা প্রয়োজন। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ধরিয়ে দেয়া, আইনের হাতে সোপর্দ করা এবং তাদের উপযুক্ত শাস্তির জন্য প্রত্যেক মানুষের সহযোগিতা লাগবে।’ প্রধানমন্ত্রীর এই আহ্বান ডিজিটাল অপরাধের ক্ষেত্রে অনেক বেশি প্রযোজ্য।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে সম্ভবত এই কথাটি বলেননি যে, সরকারের নিষেধাজ্ঞার অবস্থাটি বড়ই নাজুক। এটি এমন যে সরকার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দরজায় বিশাল আকারের একটি তালা মেরেছে। কিন্তু তারা উপলব্ধি করছে না যে সেই ঘরের জানালাগুলো সবই খোলা। ফলে সরকারের নিষেধাজ্ঞা একটি তামাশায় পরিণত হয়েছে। আমরা কোনোভাবেই সরকারকে তামাশার পাত্র হিসেবে দেখতে চাই না। তাই সবকটা জানালা খোলা রাখার মতো দরজাটাও খুলে দিন।
সরকারকে আরো বুঝতে হবে যে, সরকারের নিষেধাজ্ঞা যদি কার্যকর করা না যায় তবে সেই নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।
Source