খবরের শিরোনামঃ বকেয়া ৫ হাজার কোটি টাকা

খবরের তারিখঃ ২০১৫-১০-০১

-ফারুক হোসাইন
দীর্ঘদিন ধরে আদায় না হওয়ায় টেলিযোগাযোগ খাতে মোবাইল অপারেটরসহ বিভিন্ন লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের কাছে সরকারের রাজস্ব বকেয়া রয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর সিংহভাগই রাষ্ট্রায়ত্ত দুই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) ও মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটকের কাছে। এই দুই প্রতিষ্ঠানের কাছেই টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসি’র রাজস্ব বকেয়া ৩ হাজার ২৩০ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে অপারেটর (আইজিডব্লিউ), ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ (আইসিএক্স), ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি), পাবলিক সুইচড টেলিফোনি নেটওয়ার্ক (পিএসটিএন)অপারেটর, ওয়াইম্যাক্স সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বাংলা লায়ন, বেসরকারি মোবাইল অপারেটর সিটিসেলের কাছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থার (বিটিআরসি) পাওনা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৯০৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এছাড়া আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের কাছে বিটিআরসি’র রাজস্ব বকেয়া থাকলেও তা নিয়মিত হালনাগাদ হয়ে থাকে বলে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়। কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব (৫ হাজার কোটি টাকা) বছরের পর বছর বকেয়া থাকলেও আদায় করতে পারছে না কমিশন। যদিও প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে বকেয়া পরিশোধের জন্য বহুবার তাগাদা পত্র দেয়া হয়েছে। এমনকি চূড়ান্ত তাগাদা পত্র হিসেবেও একাধিক পত্র দিয়েছে বিটিআরসি। কিন্তু কোন কিছুই যেনো কাজে আসছে না। বরং বকেয়ার পরিমাণ বাড়ছে প্রতি মাসেই। বরাবরের মতো এবারও কমিশনের সর্বশেষ সভায় বকেয়া আদায়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ, পরিশোধের জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া এবং মামলা করার কথা জানিয়েছে বিটিআরসি।বিটিআরসি সূত্রে জানা যায়, গত জুন পর্যন্ত আয়ের রাজস্ব ভাগাভাগি, লাইসেন্স ও তরঙ্গ ফি হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি বকেয়া রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত দুই প্রতিষ্ঠান বিটিসিএল ও টেলিটকের কাছেই। এই দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া ৩ হাজার ২৩০ কোটি টাকারও বেশি। রাষ্ট্রীয় মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটকের কাছে এক হাজার ৫৮৫ কোটি টাকারও বেশি বকেয়া রয়েছে দীর্ঘ দুই বছর ধরে। থ্রিজি মোবাইল সেবার স্পেকট্রাম ফি হিসেবে টেলিটকের কাছে রাজস্ব বকেয়া রয়েছে। যদিও এই টাকা পরিশোধের সর্বশেষ সময় ছিল ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসেই। পাওনা অর্থ চেয়ে টেলিটককে ২০ টিরও বেশি চিঠি দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। এসব চিঠির কোন জবাব দেয়ার প্রয়োজনই মনে করেনি অপারেটরটি। বরং টাকা না দেয়ার বিষয়ে তাদের অবস্থানের কথাও জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ২০১২ সালের অক্টোবরে সরকার দেশের প্রথম মোবাইল অপারেটর হিসেবে টেলিটককে থ্রিজি প্রযুক্তির বাণিজ্যিক সেবা পরীক্ষামূলকভাবে চালুর অনুমোদন দেয়। এরই মধ্যে এক লাখেরও বেশি থ্রিজি গ্রাহক পেয়েছে টেলিটক। তবে থ্রিজি সেবাদানে বরাদ্দ দেয়া ১০ মেগাহার্টজ তরঙ্গের মূল্য এখনো পরিশোধ করতে করেনি প্রতিষ্ঠানটি। মোবাইল ফোন অপারেটরদের লাইসেন্সিং নীতিমালা অনুযায়ী, প্রত্যেক অপারেটরকে তাদের আয়ের ৫ দশমিক ৫ শতাংশ বিটিআরসির মাধ্যমে সরকারকে দেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অপারেটরদের বার্ষিক লাইসেন্স ফি ৫ কোটি টাকা। বিটিআরসি সূত্রে জানা গেছে, টেলিটক তিন বছরের বেশি সময় ধরে রেভিনিউ শেয়ারিংয়ের টাকা পরিশোধ করছে না। এজন্য একাধিকবার চিঠি দেয়া হলেও তার কোনো জবাব দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে টেলিটক বিশেষ ক্ষেত্রে সুবিধা পেয়ে থাকে। টেলিটক সরকারি কোষাগারে নিয়মমাফিক টাকা জমা না দেয়ায় তা এ খাতের বেসরকারি অন্য অপারেটরদের মধ্যে একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে উৎসাহ জোগাতে পারে বলে মনে করছে বিটিআরসি। টাকা না দেয়ার কথা জানিয়ে টেলিটকের এমডি গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বলেন, টেলিটক সরকারি প্রতিষ্ঠান। এর অবকাঠামোর জন্য অর্থ দিতে হবে কেন? রাষ্ট্রায়ত্ত অপর প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) কাছে আন্তর্জাতিক ইনকামিং কল ও অভ্যন্তরীণ ফিক্সড ফোনসেবা থেকে আয়ের ভাগাভাগির অংশ এবং লাইসেন্স, তরঙ্গ বরাদ্দ ও বিলম্ব ফি হিসেবে বিটিসিএলের কাছে সরকারের পাওনার এক হাজার ৬৪৫ কোটি ২৯ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির পাবলিক সুইচড টেলিফোন নেটওয়ার্ক (পিএসটিএন), ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) ও ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ (আইসিএক্স) লাইসেন্সের আওতায় পরিচালিত কার্যক্রমের বিপরীতে এ বকেয়া দাঁড়িয়েছে। জানা গেছে, ২০০৮ সালের অক্টোবর থেকে গত জুন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ইনকামিং কলের আয় ভাগাভাগির অংশ হিসেবে বিটিসিএলের আইজিডব্লিউ ক্ষেত্রে ৯৩৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা, আইসিএক্স ক্ষেত্রে ৪৮৫ কোটি, পিএসটিএন অপারেটর হিসেবে ১৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা এবং পিএসটিএন অপারেটর হিসেবে অভ্যন্তরীণ কলের রেভিনিউ শেয়ারিং-এর জন্য ১৭৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিকে বহুবার বকেয়া পরিশোধের জন্য চিঠি দেয়া হলেও কোন কাজে আসেনি। এছাড়া ২০০৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০০৭-এর জুলাই পর্যন্ত রাজস্ব আয়ের ভাগাভাগির অর্থ বিলম্বে পরিশোধের কারণে ৩৯ কোটি ৩৫ লাখ টাকা, ২০০৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০০৫-এর জানুয়ারি পর্যন্ত লাইসেন্স ফি নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ না করায় ৪৬ লাখ টাকা এবং তরঙ্গ বরাদ্দ ফি পরিশোধে বিলম্বের কারণে আরো ২২ লাখ টাকাসহ মোট ৪০ কোটি ৩ লাখ টাকা বিটিসিএলের কাছে বিলম্ব ফি হিসেবে দাবি করে আসছে বিটিআরসি। টেলিযোগাযোগ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো নির্ধারিত সময়ের ভেতরে রাজস্ব আয়ের ভাগাভাগির অর্থ, লাইসেন্স ফি ও তরঙ্গ বরাদ্দ ফি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে বিলম্ব ফি আদায়ের বিধান রয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিলম্ব ফি না নেয়ার জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের কাছে আবেদন করে বিটিসিএল। আবেদনে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, ২০০৮ সালের ৩০ জুনের আগে সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিটিসিএলের আয়ের পুরোটাই সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হতো। এ সময়ে বিটিটিবির (বর্তমানে বিটিসিএল) ব্যয় নির্ভর ছিল সরকারি বরাদ্দের ওপর। ফলে বরাদ্দ না থাকায় নির্ধারিত সময়ে এসব ফি জমা দিতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। একটি সেবাধর্মী সরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিলম্ব ফি মওকুফের দাবি জানায় বিটিসিএল। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ বিষয়টি অনুমোদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। তবে বিলম্ব ফি মওকুফ চেয়ে বিটিসিএলের আবেদনে অনুমোদন দেয়নি অর্থ মন্ত্রণালয়। রাষ্ট্রায়ত্ত এই দুই প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বিটিআরসি’র এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, সরকারি এই দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে আমরা পাওনা পরিশোধের জন্য ২১ দিনের সময় দিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে টাকা পরিশোধ না করলে পিডিআর এ্যাক্ট ও বিটিআর এ্যাক্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। তবে বিটিআরসি’র পক্ষ থেকে এর আগেও এধরনের একথা একাধিকবার বলা হয়েছে। প্রতিবারই বকেয়া আদায়ের বিষয়ে এসব কথা বলা হলেও কার্যত কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এই দুই প্রতিষ্ঠান ছাড়াও আইজিডব্লিউ, আইসিএক্স, আইআইজি, সিটিসেল ও বাংলা লায়নের কাছে গত জুন পর্যন্ত বিটিআরসি’র বকেয়া রয়েছে এক হাজার ৯০৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিটিসিএল ছাড়া ২৮ আইজিডব্লিউ অপারেটরের কাছে বকেয়া রয়েছে ৭৮৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এর সিংহভাগই আবার ৬ টি প্রতিষ্ঠানের কাছে। এই ছয় প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া রয়েছে ৬৮৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এই ছয় প্রতিষ্ঠান এস এম টেলিকমিউনিকেশন, কে টেলিকমিউনিকেশন্স, ভিশন টেল, বেসটেক টেলিকম, টেলেক্স ও রাতুল টেলিকম। এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে বিটিআরসি। এছাড়া অ্যাপল গ্লোবাল টেলের ৭৮ কোটি টাকার রাজস্ব বকেয়া থাকায় কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ করে দিয়েছে কমিশন। ২৫টি ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ (আইসিএক্স) লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বকেয়া রয়েছে ৭৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব ভাগাভাগি ৬৭৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা এবং বিলম্ব ফি ৭০ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) প্রতিষ্ঠানের কাছে সরকারের রাজস্ব পাওনা ১১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। আইজিডব্লিউ, আইসিএক্স, আইআইজি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে বকেয়া আদায় বিষয়ে বিটিআরসি’র পক্ষ থেকে বলা হয়, তাদেরকে বকেয়া পরিশোধের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। এছাড়া ৬ আইডিজব্লিউ অপারেটরের বিরুদ্ধে মামলা চলমান রয়েছে। এছাড়া বেসরকারি মোবাইল অপারেটর সিটিসেলের কাছে ২৭৪ কোটি টাকা ও ওয়াইম্যাক্স সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলা লায়নের কাছে ৪৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা টাকা বকেয়া রয়েছে।

Source