-যুগান্তর রিপোর্ট
আন্তর্জাতিক ইনকামিং কলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়। বিটিসিএল বলছে, মন্ত্রণালয়ের সচিব পদাধিকার বলে সংস্থার চেয়ারম্যান। তার সভাপতিত্বে বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কল রেট বাড়ানো হয়েছে। অপরদিকে টেলিকম মন্ত্রণালয় বলছে, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হলেও বিটিসিএলের এ সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয় জানে না। খোদ ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম সাংবাদিকদের বলেন, বিটিসিএলের কল রেট বাড়ানোর কোনো ফাইল আমার কাছে আসেনি। সচিব তো এখন বিদেশে আছেন, আমাকে না জানিয়ে বিটিসিএল কার অনুমতি নিয়ে কল রেট বাড়াল, সেটা তাদেরই জিজ্ঞেস করেন। এদিকে মন্ত্রণালয়কে এড়িয়ে গোপনে আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশন রেট বাড়ানোর কারণে চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে বিটিসিএলের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন দেশে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল ক্যারিয়ারগুলো। তারাই বিভিন্ন দেশ থেকে কল সংগ্রহ করে বিটিসিএলের মাধ্যমে দেশে পাঠাত। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, নিয়ম অনুযায়ী কলরেট বাড়াতে হলে ন্যূনতম ৭-১৫ দিনের নোটিশ দিতে হয়। এটা আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ আইনের অংশ। বিটিসিএল এ আইন লংঘন করে মাত্র একদিনের নোটিশে মূল্যবৃদ্ধি করছে। আর দাম বৃদ্ধির এ প্রভাবে ইতিমধ্যে বিটিসিএলের কলের পরিমাণও কমে গেছে। আন্তর্জাতিক গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) অপারেটর হিসেবে চারদিনের ব্যবধানে প্রায় ১ কোটি মিনিট কল কমেছে বিটিসিএলের। সূত্র জানায়, এতদিন মিনিটপ্রতি দেড় সেন্টে কল আনলেও ১ ডিসেম্বর থেকে মিনিটপ্রতি দুই সেন্টে দেশে কল আনতে শুরু করেছে বিটিসিএল।
জানা গেছে, বিটিসিএলের সঙ্গে সম্পৃক্ত অপারেটরগুলো বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে অবহিত করবে। একই সঙ্গে রেট বৃদ্ধির ফলে তাদের কি পরিমাণ ক্ষতি হবে তাও তুলে ধরবে। আজকালের মধ্যেই নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে তা লিখিতভাবে মন্ত্রণালয়কে জানাবে বলে একটি শীর্ষ অপারেটর সূত্রে জানা গেছে।
বিভিন্ন দেশে অবস্থিত আন্তর্জাতিক টেলিকম অপারেটরদের বক্তব্য, ৩০ নভেম্বর বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদ সভায় কল রেট বাড়ানো হয়। রহস্যজনকভাবে পরদিনই তা কার্যকর করা হয়। একদিনের ব্যবধানে কল রেটের এত তারতম্যে হতবাক তারা। এর মধ্যেই ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে অনেক ছোট প্রতিষ্ঠানের। এর মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দেশে অবস্থিত তাদের স্থানীয় এজেন্টের মাধ্যমে আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়েছে। যারা আদালতে না গিয়ে ঝামেলা এড়ানোর চেষ্টা করছেন তারা বিষয়টি নিজ নিজ দেশের দূতাবাসে লিখিতভাবে জানিয়েছেন। এতে ক্ষু হচ্ছে দেশের ইমেজ।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক ইনকামিং কলের জন্য বিটিসিএলের নিবন্ধন ফি এবং আনুষঙ্গিক খরচ প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। এ টাকা বিনিয়োগ করে এখন চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে চুক্তিভুক্ত ইন্টারন্যাশনাল ক্যারিয়ারগুলো। তাদের হিসাব অনুযায়ী, নতুন কলরেট কার্যকরের ৪ দিনের ব্যবধানে বিটিসিএলের কলের পরিমাণ এক কোটি মিনিট কমে গেছে। ফলে শুধু বিদেশী প্রাইভেট ক্যারিয়ারই নয়, বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে বাংলাদেশ সরকারও। এ ছাড়াও প্রতি মিনিট ২ সেন্ট রেট আন্তর্জাতিক টেলিকম বাজারের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, বিটিসিএল কল রেট বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত এমন সময় কার্যকর করল যখন বিদেশ থেকে আসা আন্তর্জাতিক কলের সর্বোচ্চ সীমা (সিলিং রেট) ১ দশমিক ৭ সেন্ট বেঁধে দেয়ার একটি প্রস্তাব সরকারের বিবেচনাধীন। এ সিদ্ধান্ত নেয়া হলে বিটিসিএলসহ দেশের ২৩টি আইজিডব্লিউ অপারেটরকেও একই রেটে কল আনতে হতো।
বেসরকারি আইজিডব্লিউগুলো ২৪ আগস্ট থেকে মিনিটপ্রতি দুই সেন্টে আন্তর্জাতিক কল আনছে। বিটিসিএল ও আইজিডব্লিউ অপারেটরদের মধ্যে থাকা কল রেটের এ বৈষম্য নিয়ে মন্ত্রণালয়ে আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয় ও টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) চিঠি দেয় বিটিসিএল। চিঠিতে বিটিসিএল জানিয়েছিল, তারা কি দেড় সেন্টে কল আনবে নাকি বেসরকারি আইজিডব্লিউ অপারেটরদের রেট অনুযায়ী ২ সেন্টে আনবে। বিটিআরসি তাদের জবাব দিলেও মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। এর মধ্যে বিটিসিএলের এ সিদ্ধান্ত খুবই অবাস্তব বলে মন্ত্রণালয়ের ওই শীর্ষ কর্মকর্তা জানান। জানা গেছে, ৩০ নভেম্বর যেখানে বিটিসিএলের মাধ্যমে ১ কোটি ৯০ লাখ মিনিট কল এসেছে, সেখানে শনিবার তা ৯০ লাখ মিনিটে নেমে এসেছে।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক কল রেটের সর্বনিু সীমা (ফ্লোর রেট) তিন সেন্ট থেকে কমিয়ে দেড় সেন্ট করা হয়। ওই সময় সর্বনিু রেট অর্থাৎ দেড় সেন্টেই রাজস্ব ভাগাভাগির নিয়ম রেখে আন্তর্জাতিক কল আনার নতুন পদ্ধতি পরীক্ষামূলকভাবে চালুর অনুমোদন দেয়া হয়। কল টার্মিনেশন রেট যখন তিন সেন্ট ছিল, তখন কল রেট বাড়ানোর সর্বোচ্চ সীমা (সিলিং রেট) ছিল সাড়ে তিন সেন্ট। কিন্তু পরে কল রেট কমিয়ে দেড় সেন্ট করার সময় আর সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা হয়নি। কল রেটের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে না দেয়ার এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে বাড়তি আয় করে যাচ্ছে আইজিডব্লিউ অপারেটররা।
মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা জানান, বিটিসিএলের এ সিদ্ধান্ত বেসরকারি আইজিডব্লিউ অপারেটরদের লাভ বেশি হয়েছে। এ অবস্থা আর কিছুদিন চললে বিটিসিএলের আয় শূন্যে নেমে আসবে। তিনি বিটিসিএলের এ সিদ্ধান্তের নেপথ্যে বেসরকারি আইজিডব্লিউদের হাত রয়েছে কিনা তা তদন্ত করে দেখার দাবি জানান।
এ প্রসঙ্গে বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম ফখরুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ কল রেট বাড়ানো হয়েছে। তিনি আরও জানান, ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব পদাধিকার বলে বিটিসিএলের বোর্ডের প্রধান, বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের না জানার কোনা কারণ নেই।
Source