খবরের শিরোনামঃ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব শূন্য

খবরের তারিখঃ ২০১৫-১২-০৫

-নিজস্ব প্রতিবেদক
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে। গত বুধবার ব্যারেলপ্রতি তা ৪০ ডলারে বিক্রি হয়। তবে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমার কোনো সুফল পায়নি দেশের মানুষ। অর্থনীতিতেও পড়েনি কোনো প্রভাব। এ পরিস্থিতি কেবল বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) মুনাফার অঙ্কই বড় করেছে। এর পরও জ্বালানি তেলের ভ্যাট বা সরকারের ঋণ পরিশোধ করতে চাইছে না বিপিসি। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, জ্বালানি তেলের মূল্যহ্রাস ও স্থিতিশীলতা অর্থনীতিকে উদ্দীপ্ত করে। এটি ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের ব্যয় কমায়। ফলে ভোক্তাদের ব্যয়যোগ্য (ডিসপোজেবল) আয় বাড়ে, যা অন্যান্য খাতে ব্যয় বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করে। জ্বালানির মূল্যহ্রাসে সব ধরনের উৎপাদন ব্যয় কমে, যা শিল্প ও সেবাপণ্যের দাম কমাতে ভূমিকা রাখে। এর ঠিক উল্টোটা ঘটে জ্বালানির দাম বেশি থাকলে। তেলের উচ্চমূল্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস করে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাম্প্রতিক এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে নিম্নমুখী হওয়া সত্ত্বেও দেশের বাজারে দাম অপরিবর্তিত রাখায় জ্বালানি তেলে সরকারের ভর্তুকি আর নেই। তবে এ মূল্যহ্রাস দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতিতে কোনো ভূমিকা রাখছে না। বরং এটি বিপিসির মুনাফার আকার বড় করছে। এতে সংস্থাটির ব্যাংক ডিপোজিট বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম কমালে তা স্বাভাবিকভাবেই মূল্যস্ফীতি কমাবে। পরিবহন ভাড়া, উৎপাদন খরচ ইত্যাদি কমবে। এতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে দাম না কমানোয় এখন এসবে কোনো প্রভাব নেই। তিনি আরো বলেন, জ্বালানি তেলের দাম না কমানোর জন্য যে যুক্তি ব্যবহার করা হয়, তা গ্রহণযোগ্য নয়। বরং সরকারের উচিত, এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে জ্বালানি তেলের বাজারভিত্তিক মূল্য নির্ধারণ করা। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে কমলে দেশের বাজারে দাম কমবে। আবার আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়লে দেশের বাজারে তেলের দাম বাড়বে। আর জনগণের বিষয়টি জানা থাকলে তারা তা মেনে নিতেও আপত্তি করবে না। আইএমএফ এক হিসাবে দেখিয়েছে, জ্বালানি তেলের দাম পরিবর্তনের ফলে চলতি অর্থবছর জিডিপির ১ দশমিক ২ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হবে। এর মধ্যে দশমিক ৫ শতাংশ বিপিসি ব্যাংক ডিপোজিট আকারে জমা রাখবে ও দশমিক ৫ শতাংশ মূলধনি ব্যয় খাতে খরচ করবে। বিপিসির হিসাবেও আইএমএফের এ হিসাবের সত্যতার প্রমাণ মেলে। সংস্থাটির হিসাবে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার মুনাফা করেছে সংস্থাটি। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য অপরিবর্তিত থাকলে অর্থবছর শেষে তা ৭ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। আর গত অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা ছিল ৫ হাজার কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংক এক হিসাবে দেখায়, পেট্রল ও অকটেনে ৬০ শতাংশের বেশি মুনাফা করছে বিপিসি। এছাড়া ফার্নেস অয়েলে ৫০ শতাংশ, জেট ফুয়েলে ৩৪, ডিজেলে ২৭ ও কেরোসিনে ২৫ শতাংশ মুনাফা করছে প্রতিষ্ঠানটি। এ হিসাব গত ফেব্রুয়ারির বিপিসির ক্রয়মূল্য ধরে। তবে বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য অনুযায়ী, এ মুনাফা আরো বাড়বে বলে মনে করছে খোদ বিপিসি। এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম বলেন, বিপিসি কত লাভ করছে, কীভাবে করছে তার হিসাব কেউ জানে না। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কাছে তাদের জবাবদিহিতার কথা থাকলেও তারা তা করছে না। প্রতিষ্ঠানটি বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য করে। কিন্তু সে হিসাবে এখানে কোনো জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নেই। ফলে অবাধ দুর্নীতি ও অনিয়মের সুযোগ রয়েছে। সরকার এ বিষয়ে নজর দিলে রাষ্ট্রের আর্থিক সাশ্রয় হবে। তিনি আরো বলেন, বিপিসির যখন লোকসান হয়েছে জনগণের অর্থে তাদের ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কমায় বিপিসি এখন লাভ করছে। এ লাভের অংশীদার জনগণ। তিনি বলেন, জ্বালানি উন্নয়ন তহবিল করে লাভের টাকা সেখানে জমা রাখলে জ্বালানি খাতের উন্নয়নে সেটা ব্যয় করা যাবে। এদিকে মুনাফা করলেও এখনই সরকারের ঋণ পরিশোধে আগ্রহী নয় বিপিসি। উল্টো সরকারের কাছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা মওকুফ চেয়েছে সংস্থাটি। যদিও মুনাফায় ফেরায় বিপিসির কাছে ঋণের অর্থ ফেরত চায় সরকার। কিন্তু বিপিসি বলছে, সরকার যেটাকে ঋণ বলছে, সেটা আসলে ঋণ নয়, ভর্তুকি। এটা বিপিসির প্রাপ্য ছিল। তাই সরকারকে এটা ফেরত দিতে বাধ্য নয় তারা। উল্লেখ্য, গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বিপিসির চেয়ারম্যান জ্বালানি সচিবের কাছে এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি দেন। ওই চিঠিতে জানানো হয়, ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত সরকার অর্থ বিভাগের মাধ্যমে ৩ ও ৫ শতাংশ সুদে ২৬ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকার ঋণ প্রদান করে। এছাড়া ২০০৫-০৬, ২০০৭-০৮, ২০১১-১২ এবং ২০১২-১৩ অর্থবছরে বিপিসির বিভিন্ন ব্যাংকের ঋণের বিপরীতে ১৭ হাজার ২২৮ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করে। এ ঋণ মওকুফের জন্য বিপিসির পক্ষ থেকে যুক্তি তুলে ধরা হয়। এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, বিপিসি মুনাফা করলে অতিরিক্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তহবিলে ব্যয়ের পর যে উদ্বৃত্ত থাকে, তা সরকারি কোষাগারে জমা দেয়া হয়। বিপিসির ক্ষেত্রেও এটি করতে হবে। অতিরিক্ত অর্থ বিপিসি তার নিজস্ব হিসাবে রাখতে পারবে না। তবে বিপিসি মুনাফার অর্থও সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি। এ বিষয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান এএম বদরুদ্দোজা বলেন, সরকার বিপিসিকে জ্বালানি তেলে ভর্তুকি দিয়েছে। ভর্তুকির বাইরে কোনো টাকা দেয়নি। বিপিসি বেশি দামে তেল কিনে কম দামে বিক্রি করেছে। সরকারের পলিসি অনুযায়ী এটি করেছে। সেক্ষেত্রে বিপিসির বিশাল ঘাটতি হয়েছে। ওই ঘাটতি পূরণে ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয় এটাকে ঋণ হিসেবে দেখলেও আসলে এটি ঋণ নয়। আর ঋণ যেহেতু নয়, বিপিসি এ অর্থ পরিশোধে বাধ্য নয়। তিনি বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠান মুনাফা করলে সরকারকে লভ্যাংশ দেয়। কিন্তু বিপিসির সে অবস্থা নেই। প্রতিষ্ঠানটির ব্যালান্সশিট নেগেটিভ। সরকার বিষয়টি জানে। সবার আগে ব্যালান্সশিট ঠিক করতে হবে। তার পর সরকারকে অর্থ দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এদিকে বিপিসির ২ হাজার ৬২১ কোটি টাকার ভ্যাট বকেয়া রয়ে গেছে। এ অর্থও পরিশোধে রাজি নয় সংস্থাটি। এ প্রসঙ্গে বিপিসির চেয়ারম্যান বলেন, বিষয়টি নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে আলোচনা চলছে। তাদের দাবি সঠিক কিনা, তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সবকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।

Source