খবরের শিরোনামঃ সাইবার অপরাধের শিকার মূলত নারী

খবরের তারিখঃ ২০১৫-১০-০৬

-মো. আসাদুজ্জামান
সাইবার অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে মূলত নারীর বিরুদ্ধে। ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানা ও দেশের একমাত্র সাইবার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে যে ৮২ শতাংশ সাইবার অপরাধ ঘটনার শিকার নারী।আদালত ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নারীকে বেকায়দায় ফেলে সুবিধা বা চাঁদা আদায়, নারীকে অপদস্থ করা, উত্ত্যক্ত করা বা সমাজে হেয় করার জন্য এসব অপরাধ করা হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে বিয়ে বন্ধ বা ভেঙে দেওয়ার জন্যও এমন করা হয়। এসব ক্ষেত্রে নারী বা তাঁর অভিভাবক বিচার চেয়ে মামলা করেছেন। এসব মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রেম বা বিয়ের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ ওয়েবসাইটে নারীর নগ্ন ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করেছে নারীর একসময়ের ঘনিষ্ঠরা। আবার অপরাধীরা ফটোশপের মাধ্যমে নারীর ছবি বিকৃত করে প্রকাশ করছে। সাইবার ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার আদালতের বেশির ভাগ মামলার ঘটনা প্রায় একই ধরনের। কোনো মেয়ের সঙ্গে কোনো ছেলের সম্পর্ক ছিল। তাদের সম্পর্কের ছবি বা নগ্ন ছবি ফেসবুকে ছেড়ে দিয়েছে ওই মেয়ের একসময়ের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা। আবার বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর সম্পর্ক থাকাকালীন ধারণ করা ছবিও ছেড়ে দিয়েছে আসামিরা।’ শাহবাগ থানায় দায়ের করা একটি মামলার কাগজপত্রে দেখা যায়, ছেলেটি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। ২০০৮ সালে একটি মেয়ের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মেয়েটির অজ্ঞাতে ধারণ করা আপত্তিকর ভিডিওচিত্র ছেলেটি পর্ণ সাইটে ছেড়ে দেন ২০১৪ সালে। ঘটনাটি মেয়ের বাবার নজরে এলে তিনি এই ছেলের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন। এসব ব্যাপারে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাইবার অপরাধীদের প্রধান টার্গেট (লক্ষ্যবস্তু) নারী। প্রতিনিয়ত নারীরা সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বন্ধ করতে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার।’ একমাত্র সাইবার ট্রাইব্যুনালটি ২০১৩ সালে ঢাকায় স্থাপিত হয়। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে ১০৫টি মামলার বিচার চলছে। এর মধ্যে ৯২টি মামলার বাদী নির্যাতিত নারী বা তাঁর অভিভাবক। অন্যদিকে গত আড়াই বছরে ঢাকা মহানগরের ৩৭টি থানায় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে মামলা হয়েছে ৯৭টি। এর মধ্যে মিরপুর মডেল থানায় সর্বোচ্চ ১৭টি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া রমনা থানায় ১২টি, শাহবাগ থানায় ৯টি, বনানী থানায় ৬টি, পল্লবী থানায় ৪টি, খিলগাঁও থানায় ৩টি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া মোহাম্মদপুর, আদাবর, ক্যান্টনমেন্ট, দারুসসালাম, রূপনগর, উত্তরা-পশ্চিম, দক্ষিণখান, সবুজবাগ, রামপুরা, কোতোয়ালি, ওয়ারী, শেরেবাংলা, ভাটারা, তেজগাঁও ও গুলশান থানায় দুটি করে মামলা হয়েছে। আর ডেমরা, পল্টন, মতিঝিল, শাজাহানপুর, তেজগাঁও শিল্প, কদমতলী, কাফরুল, চকবাজার, কামরাঙ্গীরচর, বংশাল, শাহ আলী, গেন্ডারিয়া, উত্তরা পূর্ব, বাড্ডা, হাজারীবাগ ও তুরাগ থানায় একটি করে মামলা হয়েছে। এর মধ্যে অপরাধের শিকার নারী বা তাঁর স্বজন বাদী হয়ে ৭৪টি মামলা করেছেন। অপরাধের অন্য ঘটনার মধ্যে আছে রাষ্ট্রবিরোধী আপত্তিকর মন্তব্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর বিরুদ্ধে আপত্তিকর উক্তি ও বিকৃত ছবি প্রকাশ, ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো। সাইবার অপরাধের শিকার একাধিক নারী জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সহায়তা চেয়েছেন। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক আইনজীবী সালমা আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘নারীদের এমন সব আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করা হচ্ছে, যা কল্পনাও করা যায় না। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে অপরাধ কমবে।’ দেখা যাচ্ছে, বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর দাম্পত্যজীবনের গোপন বিষয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রকাশ করা হচ্ছে। ক্যান্টনমেন্ট থানায় করা একটি মামলার কাগজপত্রে দেখা যায়, গত বছর বিয়ে হওয়ার পর স্ত্রী জানতে পারেন তাঁর স্বামীর স্বভাব-চরিত্র খারাপ। তাঁদের আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ হয়। এরপর গত জুনে মেয়েটি জানতে পারেন, তাঁর আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দিয়েছেন সাবেক স্বামী। মেয়েটি নিজেই বাদী হয়ে সাবেক স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি মা-বাবা ও অভিভাবকদের আরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে জুনাইদ আহ্মেদ পলক জানিয়েছেন, এ ধরনের অপরাধ কমানোর জন্য তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় আইন করছে। ইতিমধ্যে সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়া তৈরি হয়েছে। খুব শিগগির তা মন্ত্রিসভায় তোলা হবে। এ ছাড়া সাইবার অপরাধ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। অপরাধীদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও ধরার জন্য ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব করা হবে।

Source