খবরের শিরোনামঃ ভারতে ব্যান্ডউইথ রফতানি করছে বাংলাদেশ

খবরের তারিখঃ ২০১৫-১০-০৬

-নাজমুল লিখন:
দু’দফা সময় পেছানোর পর চলতি মাসের মাঝামাঝি ভারতে ব্যান্ডউইথ রফতানি শুরু হতে যাচ্ছে। সবধরনের প্রস্তুতি থাকলেও ভারতের কারণে রফতানির সময় পিছিয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিসিএল)। এদিকে ভারত ছাড়া ইতালিতেও ব্যান্ডউইথ রফতানির পরিকল্পনা করছে সরকার। রফতানির এই তালিকায় রয়েছে নেপাল ও ভুটানের নাম। মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুরও বাংলাদেশ থেকে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ব্যান্ডউইথ রফতানি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের তথ্য-প্রযুক্তিবিদদের অনেকেই। তারা বলছেন, সারাদেশে এখনও ব্যান্ডউইথ ছড়িয়ে না দিয়ে বিদেশে রফতানির সিদ্ধান্ত একেবারেই অযৌক্তিক। এটি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আর সরকারের তরফ থেকে দাবি করা হচ্ছে, দেশের চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়েই কেবল অব্যবহূত ব্যান্ডউইথ রফতানি করা হবে। বিএসসিসিএল সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের মে মাসে ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিএসএনএল বাংলাদেশ থেকে ১০ জিবিপিএস (গিগাবাইট পার সেকেন্ড) ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ কিনতে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করে। শুরুতে ১০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ রফতানি করা হলেও পরে তা ৪০ জিবিপিএস পর্যন্ত উন্নীত করা হবে। এজন্য ফ্রান্স থেকে ৫ গিগা এবং সিঙ্গাপুর থেকে ৫ গিগাসহ ১০ গিগা ব্যান্ডউইথ নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছে বিএসসিসিএল। ইতোমধ্যে গত মাসে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত পরীক্ষামূলকভাবে ব্যান্ডউইথ সরবরাহ করা হয়েছে। সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া প্রান্ত দিয়ে ভারতের আগরতলা এবং সিলেট প্রান্তে তামাবিল সীমান্ত দিয়ে ভারতের শিলংয়ে ব্যান্ডউইথ সংযোগ নেওয়া হবে। এই ব্যান্ডউইথ ভারতের আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর ও অরুণাচল রাজ্যে ইন্টারনেট সেবায় ব্যবহূত হবে। ভারতে প্রতি মেগাবাইট ব্যান্ডউইথ বিক্রি হবে ১০ মার্কিন ডলারে। এই হিসাবে ১০ গিগাবাইট ব্যান্ডউইথ রফতানি করে প্রতি বছর ৯ কোটি টাকারও বেশি আয় হবে। জানতে চাইলে বিএসসিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনোয়ার হোসেন সকালের খবরকে জানান, ‘আমাদের প্রস্তুতি আরও আগেই শেষ হয়েছে। কিন্তু ভারতের কিছু কারিগরি কাজ এখনও বাকি থাকায় ব্যান্ডউইথ রফতানি করতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। তবে ভারত আমাদের যে হিসাব দিয়েছে তাতে আশা করা হচ্ছে অক্টোবরের মাঝামাঝি রফতানি করা সম্ভব হবে। নিরবচ্ছিন্ন ব্যান্ডউইথ দিতে না পারলে জরিমানা : ভারতে নিরবচ্ছিন্ন ব্যান্ডউইথ রফতানি করতে না পারলে জরিমানা গুনতে হবে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিসিএল) সঙ্গে ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিএসএনএলের চুক্তিতে এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি সেকেন্ডে ১০ গিগাবাইট ব্যান্ডউইথের ৯৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ সরবরাহ করতে না পারলে প্রতি মাসে সাড়ে ৩ ঘণ্টা জরিমানা দিতে হবে। ইতালিতে ব্যান্ডউইথ রফতানি : ভারতের পর ইতালিতেও ব্যান্ডউইথ রফতানি করবে সরকার। তবে সেখানে খুবই কম দামে ব্যান্ডউইথ রফতানির উদ্যোগ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ইতালিতে ব্যান্ডউইথ রফতানির জন্য সরকার ১৫ বছরের একটি চুক্তি করতে যাচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ ৫৭ গিগা ব্যান্ডউইথ রফতানি করবে ইতালিতে। গত আগস্টে ইতালির টেলিকম ইতালিয়া স্পার্কেল (টিআইএস) কোম্পানির কাছে স্বতন্ত্র ব্যবহারের শর্তে ব্যান্ডউইথ বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ইতালিতে আড়াই মিলিয়ন এমআইইউ অব্যবহূত ব্যান্ডউইথ রফতানির মাধ্যমে বছরে ১৪০ মিলিয়ন বা ১৪ কোটি টাকা আয় হবে। অথচ ভারতে ১০ গিগা ব্যান্ডউইথ প্রায় একই দামে রফতানি করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বিএসসিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনোয়ার হোসেন সকালের খবরকে জানান, মন্ত্রী মহোদয় বিষয়টি আরও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে বলেছেন। আগামী ৬ অক্টোবর (আজ) বোর্ড মিটিংয়ে এ নিয়ে আলোচনা হবে। সেখানে দাম ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা হবে। তবে ভারতের সঙ্গে ইতালির দামের তুলনা করলে চলবে না। কারণ ভারতে ব্যান্ডউইথ রফতানি করতে গেলে আমাকে বিদেশের ব্যাকহল চার্জ, আইপি ট্রানজিট, পোর্ট চার্জ, ওয়েট সেগমেন্ট চার্জ, ইন্টারকানেকশন কানেক্টিভিটি চার্জসহ অন্যান্য কম্পোন্যান্ট বাবদ ব্যয় হবে। এজন্য ভারতে বেশি দামে রফতানি করা হচ্ছে। কিন্তু ইতালির কাছে ব্যান্ডউইথ বিক্রির ক্ষেত্রে এসব কোনো ব্যয় হবে না। তারা সাগর থেকেই ব্যান্ডউইথ নেবে। ফলে তাদের কাছে ব্যান্ডউইথ রফতানিতে বাড়তি কোনো ব্যয় হবে না। তাছাড়া ইতালির কাছ থেকে ব্যান্ডউইথ রফতানির অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্স বাবদ বছরে পাব ৩০ লাখ টাকা। ১৫ বছরে পাব সাড়ে ৪ কোটি টাকা। ফলে এ খাত থেকে আমাদের সব মিলিয়ে আয় হবে প্রায় ১৪ কোটি টাকার মতো। প্রযুক্তিবিদদের আপত্তি : উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প আমাদের গ্রামের পরিচালক রেজা সেলিম জানান, যারা ব্যান্ডউইথ অব্যবহূত থাকার কথা বলছেন প্রকৃতপক্ষে তাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সরকারকে ভুল বুঝিয়ে একটি গোষ্ঠী ব্যান্ডউইথ রফতানির পক্ষে মত দিচ্ছে। এতে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশে ব্যান্ডউইথ মোটেই উদ্বৃত্ত নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখনও দেশের অধিকাংশ মানুষ ব্রডব্যান্ড সুবিধা থেকে বঞ্চিত। যেটুকু আছে তার গতি তুলনামূলক কম আবার দামও বেশি। এজন্য সঠিক পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। রেজা সেলিম বলেন, দেশের তরুণ প্রজন্ম এখন তথ্যপ্রযুক্তির বিষয়ে অনেক আগ্রহী। অনলাইনের মাধ্যমে অনেকে ঘরে বসেই আয় করছে। তাদেরকে যদি নামমাত্র মূল্যে উচ্চগতির ইন্টারনেট সরবরাহ করা হয় তাহলে রফতানির চেয়ে বেশি টাকা আয় হবে সরকারের। বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের (বিডিওএসএন) সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান বলেন, আসলে আমাদের ব্রডব্যান্ডের চাহিদা কত তা কিন্তু আমরা কেউই এখনও সঠিকভাবে জানি না। তাহলে আমরা কীভাবে বুঝব দেশে ব্যান্ডউইথ অব্যবহূত রয়েছে? তিনি বলেন, আমাদের দেশে প্রথম যখন মোবাইল ফোন এলো তখন বেশি দামের কারণে এর চাহিদাও কিন্তু কম ছিল। আস্তে আস্তে দাম কমার কারণে মোবাইল ফোনের বড় ধরনের বিপ্লব ঘটেছে। ঠিক ইন্টারনেটের দামও কমানো হলে তার চাহিদা তো অনেক বেড়ে যাবে। এর আগে ব্যান্ডউইথের দাম অনেক বেশি থাকায় চাহিদা কম ছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার কয়েক দফায় ইন্টারনেটের দাম অনেক কমিয়েছে। এই দাম আরও কমিয়ে সারাদেশে যদি ব্রডব্যান্ড ছড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে তাতে সুফল আরও বেশি পাওয়া যাবে। ব্যান্ডউইথ রফতানি নিয়ে প্রযুক্তিবিদদের আপত্তির বিষয়ে বিএসসিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনোয়ার হোসেন বলেন, ২০১৬ সালের ডিসেম্বর নাগাদ দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবলে যুক্ত হবে বাংলাদেশ। এতে সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পাবে। আমরা আমাদের ভবিষ্যত্ চাহিদার জন্য ব্যান্ডউইথ রেখেই উদ্বৃত্ত ব্যান্ডউইথ রফতানি করব। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বিএসসিসিএলের কাছে বর্তমানে ২০০ গিগাবাইট ব্যান্ডউইথ রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ২৫ শতাংশের মতো ব্যবহূত হচ্ছে।

Source