-ফেরদৌস আল হাসান
সাইবার অপরাধ দমন এবং এ ধরনের হয়রানি থেকে মানুষকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০০৬ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন প্রণয়ন করে। আইনের ৬৮ ধারা মোতাবেক ২০১৩ সালের শেষদিকে সাইবার অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। কিন্তু মানুষের ভোগান্তি কমেনি। যে মাত্রায় অপরাধ বাড়ছে সেই মাত্রায় বিচার প্রার্থীদের ভোগান্তিও বেড়ে চলছে।
মেহজাবীন আলম আঁখি। পেশায় শিক্ষিকা। একাত্তরে বয়স ছিল পনেরো। দেয়ালে লটকানো কাঠের ফ্রেমে বাঁধা একটি ফটো দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি তো মুক্তিযোদ্ধা আছিলাম’। দেখে যে কেউ চিনতে পারবে, ওটা সেই একাত্তরের মেডিকেল মোড়ের আমতলার ছবি। সাদা ধপধপে শাড়িতে একঝাঁক তরুণী। হাতে প্ল্যাকার্ড মেহজাবীন উদয়ন স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। পেশা শুরু করেন উদয়ন স্কুলের শিক্ষকতা দিয়ে। টানা ৩৬ বছর শিক্ষকতা করছেন।
‘কিছুদিন হয় আমার কিছু কলিগ (বেশিরভাগই পুরুষ) আমার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষাণ্বিত হয়ে আমার বিরুদ্ধে অশ্লীল, অশ্রাব্য কিছু কথাবার্তা রটিয়েছে। একটা অনলাইন পত্রিকা আমার বক্তব্য না শুনে ছাপিয়ে দেয়ায় ফেসবুকে আমার কীযে হেনস্থা তা বলতে পারব না। আমার স্বামী-ছেলে-মেয়ে কেউ লজ্জায় বাইরে বেরোতে পারে না’ বলতে বলতে আঁচলে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেললেন মুক্তিযোদ্ধা মেহজাবীন আলম।
মামলা-টামলা করেননি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী থানায় গেছিল পুলিশ নাকি মামলা নেয়নি’। পরেরদিন ঢাকার জজকোর্ট এলাকায় দেখা হয়ে যায় মেহজাবীনের স্বামী মোস্তফা কামালের সঙ্গে। চা খেতে খেতে তিনি বললেন, ‘১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আমার জবানবন্দি নেন। জজ বলেছেন, ‘পুলিশকে তদন্ত করার জন্য আদেশ দেবেন’ কিন্তু কোনো প্রতিকার পাইনি। সংশ্লিষ্ট থানায় যোগাযোগ করলে থানার ওসি প্রতিবেদককে জানান, ‘সাইবার ট্রাইব্যুনাল থেকে এ বিষয়ে কোনো তদন্ত আদেশ আমরা পাইনি।’
অনুসন্ধানে দেখা যায়, শুভঙ্করের ফাঁকিটা আইনের ভেতরে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের কোথাও বিচারককে সরাসরি মামলা আমলে নেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়নি। আইনের ৬৯ ধারায় বলা আছে, পুলিশ অথবা কন্ট্রোলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। তারপর ট্রাইব্যুনাল মামলা আমলে নেবে। অপরাধ হয়েছে কী হয়নি, মামলা আমলে নেয়া যাবে কী যাবে না, তা নির্ভর করছে পুলিশের সঠিক তদন্তের ওপর। কিন্তু সাইবার অপরাধের পুরোপুরি তদন্ত করার দক্ষ জনবল পুলিশের আছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাড্ডা থানার পুলিশ পরিদর্শক এমএ জলিল একান্ত এক সাক্ষাৎকারে মানবকণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা মোবাইল অপরাধ যেমন, চুরি, হুমকি, চাঁদাবাজি, হত্যা এসব ক্ষেত্রে অপরাধীকে শনাক্ত করতে পারছি কিন্তু, ইন্টারনেট, ফেসবুকে যে অপরাধগুলো হচ্ছে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে চিহ্নিত করা যাচ্ছে না।’ কেন যাচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যে পরিমাণ টেকনোলজি বিশেষজ্ঞ দরকার তা নেই। তাছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণ সরঞ্জামও নেই।’
ট্রাইব্যুনাল তো পুলিশের তদন্ত রিপোর্ট ছাড়া মামলা আমলে নিতে পারবে না কিন্তু পুলিশ যদি সরঞ্জামের অভাবে তদন্ত করতে না পারে তাহলে তো জনগণের ভোগান্তি আরো বেড়ে যাবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আপাতত একটু হয়রানি তো হবে কী করার বলুন। যারা তথ্য-প্রযুক্তিতে দক্ষ যেমন বিটিসিএল তাদের হাতে তদন্তের ভার দেয়া উচিত, সাইবার অপরাধ তদন্ত করার মতো যোগ্যতা পুলিশ বিভাগের এখনো হয়নি’ এমন মন্তব্য করলেন আইনজীবী প্রকাশ বিশ্বাস। মানুষের ভোগান্তির সবচেয়ে বড় কারণ হলো সারাদেশে একটি মাত্র আদালত।
সুমি আক্তার। বাড়ি পঞ্চগড়। অনার্সের ছাত্রী। ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বারান্দায় তার সঙ্গে দেখা হলো। তিনি মামলার ভিকটিম। এলাকার কিছু বখাটে ছেলে তার ছবি ফটোশপ করে নগ্ন ছবির সঙ্গে চেহারা মিলিয়ে ফেসবুকে ছেড়ে দিয়েছে। তিনি থানায় মামলাও করেছেন। কিন্তু এখন আর মামলা চালাতে চান না। কারণ পঞ্চগড় থেকে ঢাকায় এসে মামলা চালানো তার পক্ষে সম্ভব নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েরা সাইবার ক্রাইমের শিকার হলেও কাছাকাছি কোনো আদালত না থাকায় প্রতিকার পাচ্ছেন না। আইনে বলা আছে সরকার প্রতিটি জেলায় একটি করে সাইবার অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করবে। কিন্তু দীর্ঘ ৯ বছর পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত প্রতিটা জেলায় ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়নি। সারাদেশে মাত্র একটি ট্রাইব্যুনাল দিয়ে বিচার চলছে।
বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেন, সাধারণ মানুষের পক্ষে গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে মামলা চালানো সম্ভব নয়।
তাই ভোগান্তি ঠেকাতে প্রতিটি জেলায় সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠন করা উচিত।
Source