খবরের শিরোনামঃ গ্রামীণফোনের ৭শ কোটি টাকার মানি লন্ডারিং

খবরের তারিখঃ ২০১৫-১০-০৭

-মুজিব মাসুদ ও সাঈদ আহমেদ
ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ডের (ডব্লিউপিপিএফ) প্রায় ৭শ’ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন গ্রামীণফোন কর্মকর্তারা। তারা নিজেরাই শ্রমিক সেজে এ অর্থ আত্মসাৎ করেন। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এক তহবিলের অর্থ অন্য তহবিলে অবৈধভাবে স্থানান্তর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের আওতায় দণ্ডনীয় অপরাধ। বিদ্যমান আইনে বিষয়টির অনুসন্ধানের এখতিয়ার দুদকের। গ্রামীণফোনের অর্থ পাচার বিষয়ে দুদকের (দুর্নীতি দমন কমিশন) কৌঁসুলি খুরশিদ আলম খান বলেন, এক তহবিলের অর্থ অন্য তহবিলে অবৈধভাবে স্থানান্তর অবশ্যই মানি লন্ডারিং আইনে অপরাধ। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শ্রম আইন অনুযায়ী লাভজনক যে কোনো প্রতিষ্ঠান তার লভ্যাংশের অর্থ ৫ শতাংশ হারে ‘ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড’ (ডব্লিউপিপিএফ)-এ জমা হবে। এ অর্থ ডব্লিউপিপিএফ রিজার্ভ রাখতে হবে। ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত গ্রামীণফোনের লভ্যাংশের ৫ শতাংশ হিসাবে ৪ বছরে ৬৯৭ কোটি ৩৫ লাখ ৯৪ হাজার ৫৯ টাকা রিজার্ভ থাকার কথা। কিন্তু গ্রামীণফোনের লভ্যাংশে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ তহবিলের এ অর্থ হাতিয়ে নেন গ্রামীণফোনের কর্মকর্তারা। ট্রাস্টির চার সদস্যের তত্ত্বাবধানে এ অর্থ প্রতিষ্ঠানটির প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কর্মকর্তার মাঝে ভাগ-বাটোয়ারা করা হয়। এ ভাগ-বাটোয়ারার নেতৃত্বে ছিলেন গ্রামীণফোনের প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা ও বোর্ড অব মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক শরীফ আহমেদ (পদাধিকার বলে ট্রাস্টির সদস্য), একই বিভাগের সাবেক পরিচালক কাজী মোহাম্মদ শাহেদ আহমেদ (বর্তমানে তিনি টেলিনরের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইলিনরের ভারতীয় শাখার প্রধান মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক), গ্রামীণফোনের টেকনিক্যাল বিভাগের স্পেশালিস্ট ট্রাস্টির চেয়ারম্যান আহমেদ মঞ্জুর উদ্দৌলা এবং কর্মকর্তা মইনুল কাদের। তবে গ্রামীণফোন সূত্রে জানা গেছে, এদের অনেকেই এখন আর সংশ্লিষ্ট পদে নেই। শ্রম আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তা ডব্লিউপিপি ফান্ডের অর্থ পাবেন না। কিন্তু আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গ্রামীণফোনের উল্লেখিত কর্মকর্তারা শ্রমিকদের প্রায় ৭শ’ কোটি টাকা অন্য তহবিলে স্থানান্তর (মানি লন্ডারিং) এবং আত্মসাৎ করেন। হদিস নেই প্রায় ৭০০ কোটি টাকার : ২০১০ সালে গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষ আয়কর বিভাগে যে আর্থিক হিসাব বিবরণী দাখিল করে সে অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির ‘ডব্লিউপিপিএফ’ তহবিলে ১০৫ কোটি ৬৯ লাখ ৫০ হাজার ১০২ টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। ২০১১ সালে এ তহবিলে স্থানান্তর করা হয় ২৭২ কোটি ৯১ লাখ ৯১ হাজার ৭৮৭ টাকা। ২০১২ সালের ডব্লিউপিপিএফ তহবিলে ১৫৫ কোটি ২৭ লাখ ৭৭ হাজার ৭৭৪ টাকা স্থানান্তর হয়। ২০১৩ সালে দেখানো হয় ১৬৩ কোটি ৪৬ লাখ ৭৪ হাজার ৩৯৬ টাকা। অথচ গ্রামীণফোনের ‘পিপলস কাউন্সিল’র সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মিয়া মোহাম্মদ মাসুদ ২০১৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর সাংবাদিকদের জানান, ২০১০ সালে ডব্লিউপিপিএফের বাবদ গ্রহণ করা হবে ১০৪ কোটি টাকা। ২০১২ সালে ১৫১ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ ২ বছরে সাড়ে ৫ কোটি ৯৭ লাখ ২৭ হাজার ৮৭৬ টাকার হদিস পাওয়া যায়নি। বোর্ড অব ট্রাস্টি যে ৬৯১ কোটি ৩৮ লাখ ৬৬ হাজার ১৮৩ টাকা বুঝে পেয়েছে সেটিও ‘এফ’ ক্যাটাগরির ১৩ শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারীরা পাননি। ভাগাভাগি হয় গ্রামীণফোনের ‘এ’ থেকে ‘ই’ ক্যাটাগরির ৩ হাজার ৪০৭ কর্মকর্তার মধ্যে। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ কর্মচারীরা আন্দোলনে নামলে অর্থ আত্মসাৎকারী কর্মকর্তারা তাদের ওপর নির্যাতন-হয়রানি শুরু করেন। অনেকের চাকরি পর্যন্ত হারাতে হয় এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায়। চলতি বছর ১ ফেব্রুয়ারি বঞ্চিত কর্মচারীরা গ্রামীণফোন প্রধান কার্যালয়ের সামনে শান্তিপূর্ণ অবস্থান ধর্মঘট পালন করতে চাইলে র‌্যাব তাদের ব্যাপক লাঠিপেটা করে। এ ঘটনায় অনেক শ্রমিক আহত হন। গ্রামীণফোন শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ননের (রেজি নং-বি ২১৬১) সাধারণ সম্পাদক মো. কামরুল হাসান শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘শ্রমিকদের প্রায় ৭শ’ কোটি টাকার ডব্লিউপিপি ফান্ডের অর্থ গ্রামীণফোনের কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগির মাধ্যমে আÍসাৎ করেছেন। আমরা এ নিয়ে প্রতিবাদ-আন্দোলন করলে নানাভাবে নির্যাতন চালানো হয়। আমাদের অনেকেরই এখন ইনক্রিমেন্ট ও বেতন-ভাতা বন্ধ রয়েছে। আতংকে দিন কাটছে তাদের।’ তিনি বলেন, ‘২ বছরের বেশি সময় ধরে ইউনিয়ন কার্যক্রম স্থগিত করে রাখা হয়েছে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ দিয়ে। স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের আবেদন জানালেও আমাদের আবেদনের শুনানি হচ্ছে না।’ নিরাপত্তাজনিত কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শ্রমিক বলেন, ‘কোম্পানির প্রচলিত গ্রেডিং ব্যবস্থায় মারাত্মক বৈষম্য রয়েছে। নির্ধারিত ড্রেস অ্যালাউন্স, মোবাইল অ্যালাউন্স ও নাইট বিল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমরা যারা এ আত্মসাৎ নিয়ে কথা বলি তাদের নানাভাবে নির্যাতন করছে গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষ। আমাদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্টও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।’ কর্মকর্তারা ‘শ্রমিক’ সাজলেন যেভাবে : ডব্লিউপিপিএফ পরিচালিত হয় ৪ সদস্যের ট্রাস্টির মাধ্যমে। এর মধ্যে ২ জন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, ২ জন শ্রমিক প্রতিনিধি। গ্রামীণফোন কোম্পানিতেও একটি ট্রাস্টি রয়েছে। কিন্তু এ ট্রাস্টির মধ্যে রয়েছে শুভংকরের ফাঁকি। চার সদস্যের ট্রাস্টির চারজনই গ্রামীণফোনের কর্মকর্তা। শ্রমিক অংশের অর্থ আত্মসাতের লক্ষ্যে সুকৌশলে ট্রাস্টিতে বসানো হয় নিজস্ব লোকজনকে। অথচ তারা কেউ শ্রমিক নন। ট্রাস্টিতে শ্রমিকের কোনো প্রতিনিধিত্বও নেই। সূত্রমতে, ‘কোম্পানির মুনাফায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণ’ বোঝাতে গিয়ে ‘শ্রম আইন-২০০৬’ এ ২৩৩ ধারায় শ্রমিকের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। আইনটির ‘জ’ উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো কোম্পানির ‘শ্রমিক’ বলতে ওই ব্যক্তিকে বোঝাবে, যিনি পদমর্যাদা নির্বিশেষে উক্ত কোম্পানিতে অন্যূন ৬ মাস যাবত চাকরিতে নিযুক্ত আছেন, তবে নিম্মোক্ত কোনো ব্যক্তি এই আইনের আওতায় শ্রমিক সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হবেন না- (১) ব্যবস্থাপনা কিংবা প্রশাসনিক দায়িত্বে নিযুক্ত ব্যক্তি, (২) তদারকি কর্তৃত্বে নিযুক্ত ব্যক্তি যিনি পদাধিকার বলে বা তার ওপর অর্পিত ক্ষমতা বলে ব্যবস্থাপনা বা প্রশাসনিক ধরনের কাজ করে থাকেন। এ সংজ্ঞানুযায়ী তারা কেউ শ্রমিক নন। শ্রমিকের প্রতিনিধিত্বও করতে পারেন না। তা সত্ত্বেও আহম্মেদ মঞ্জুর উদ্দৌলা গং শ্রমিক সেজে ‘গ্রামীণফোন এমপ্লয়ীজ ইউনিয়ন’ নামে একটি সংগঠন করার চেষ্টা করেন। এ লক্ষ্যে প্রস্তাবিত সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পরিচয়ে মিয়া মোহাম্মদ শফিকুর রহমান মাসুদকে দিয়ে শ্রম পরিদফতরে নিবন্ধনের আবেদন করেন। কিন্তু শ্রম পরিচালক ২০১২ সালের ২৯ জুলাই আবেদনটি নাকচ করে দেন। ওই সংগঠনে গ্রামীণফোন কর্মকর্তা আহমেদ মঞ্জুর উদ্দৌলাকে দেখানো হয় প্রস্তাবিত সংগঠনের সভাপতি। শ্রম পরিদফতরের এ আদেশের বিরুদ্ধে মাসুদ ও মঞ্জুর উদ্দৌলা গং শ্রম আদালতে মামলা করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছর ১৫ এপ্রিল প্রথম শ্রম আদালত মামলাটি খারিজ করে দেন। প্রস্তাবিত সংগঠনে ১ হাজার ৫৪৪ জন গ্রামীণফোনের কর্মচারী হিসেবে সদস্য দেখানো হয়। যাদের মধ্যে ৩৭৬ জন গ্রামীণফোনে চাকরিতে বহাল নেই। বহাল ১ হাজার ১১৯ জন সদস্যদের মধ্যে মিয়া মোহাম্মদ শফিকুর রহমান মাসুদ এবং আহমেদ মঞ্জুর উদ্দৌলা এখন বহাল। তাদের ‘শ্রমিক’ দাবি করে আবেদন করা হলে শ্রম আদালত খারিজ আদেশে উক্ত দুই ব্যক্তিসহ ১ হাজার ১১৯ এমপ্লয়ীজকে ‘শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার যোগ্য নহে’ বলে উল্লেখ করেন। আদেশে বলা হয়, ‘অবশিষ্ট ১ হাজার ১১৯ জন এমপ্লয়ীজের কাজের ধরন ও প্রকৃতি অনুযায়ী দেশের শ্রম প্রতিষ্ঠানের প্রচলিত রীতিনীতি (কান্ট্রি প্র্যাকটিস এবং সামাজিক প্রেক্ষাপট) ও গ্রামীণ ফোন লিমিটেডের মতো একই ধরনের সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক সংগঠনের মধ্যে তুলনামূলক বিচারে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, উক্ত ১ হাজার ১১৯ জন এমপ্লয়ীজ শ্রমিক ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার যোগ্য নয়।’ আবেদনে মাসুদ-মঞ্জুর উদ্দৌলা গং গ্রামীণফোন এমপ্লয়ীজদের ‘এ’ থেকে ‘এফ’ পর্যন্ত ৬টি ক্যাটাগরিতে ফেলে নিজেদের ‘এফ’ ক্যাটাগরির বলে দাবি করেন। অথচ গ্রামীণফোনের বিধি অনুযায়ী ‘এ’ থেকে ‘ই’ পর্যন্ত এমপ্লয়ীজরা ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারেন না। শুধু ‘এফ’ ব্যান্ডের শ্রমিক-কর্মচারীরাই ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারেন। মামলায় গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষ লিখিতভাবে জানায়, তাদের এমপ্লয়ীজরা ৬টি ক্যাটাগরিতে বিভাজিত। এর মধ্যে প্রস্তাবিত সদস্যদের মধ্যে ‘এফ’ ক্যাটাগরির কেউ নেই। এ প্রেক্ষাপটে আদালত আবেদনকারীদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অযোগ্য ঘোষণা করে মঞ্জুর-মাসুদদের আবেদন খারিজ করে দেন। পরে অবশ্য এ আদেশের বিরুদ্ধে তারা আপিল করেন। এদিকে গ্রামীণফোনের অর্থ পাচার বিষয়ে দুদকের কৌঁসুলি খুরশিদ আলম খান বলেন, এক তহবিলের অর্থ অন্য তহবিলে অবৈধভাবে স্থানান্তর অবশ্যই মানি লন্ডারিং আইনে অপরাধ। এ ধরনের অভিযোগ আনার ক্ষেত্রে অনেকগুলো স্টেজ থাকতে হবে। অর্থ যে তহবিলে থাকার কথা সেটি অন্য তহবিলে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় স্থানান্তর হল কিনা, কারও কোনো ব্যক্তিগত তহবিলে অবৈধ প্রক্রিয়ায় অন্যায্যভাবে টাকা এলো কিনা, অর্থের উৎস কি ইত্যাদি বিষয় রয়েছে। তিনি বলেন, গ্রামীণফোনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ পাচার করছে, কিন্তু সেটি ধরাও খুব কঠিন। অবৈধপন্থায় এ অর্থ স্থানান্তর অর্থ পাচার আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ। বিদ্যমান আইনে বিষয়টি অনুসন্ধান-তদন্তের এখতিয়ার দুদকের। এ বিষয়ে আমার পরামর্শ হচ্ছে, কোনো অর্ডিনারি কর্মকর্তা দিয়ে এ ধরনের হাই অফিসিয়াল লন্ডারিংয়ের অনুসন্ধান-তদন্ত হবে না। এজন্য বিশেষায়িত জনবল প্রয়োজন। অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে জানতে আহমেদ মঞ্জুর উদ্দৌলাকে ফোন করা হলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, পিআর (জনসংযোগ বিভাগ) সেকশনের মাধ্যমে কথা বলুন। অভিযোগের বিষয়ে জানতে গ্রামীণফোনের জনসংযোগ বিভাগে বৃহস্পতিবার ই-মেইলে লিখিত প্রশ্ন পাঠানো হলেও সোমবার সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। এ প্রসঙ্গে গ্রামীণফোনের হেড অফ এক্সটার্নাল কমিউনিকেশন সৈয়দ তালাত কামাল যুগান্তরকে বলেন, ২০১০-১২ সালের তহবিল নিয়ে উত্তর দেয়ার এখতিয়ার শুধু বোর্ড অফ ট্রাস্টির। প্রস্তাবিত গ্রামীণফোন এমপ্লয়ীজ ইউনিয়ন গঠনের বিষয়টি বর্তমানে শ্রম আপিলাত ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন আছে। তাই এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা সম্ভব নয়।

Source