খবরের শিরোনামঃ শুরু থেকেই ভুল পথে টেলিটক

খবরের তারিখঃ ২০১৫-১০-১১

-জেসমিন মলি ও সুমন আফসার
সেলফোন খাতে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা ও জনগণের সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠা হয় টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড। কিন্তু শুরু থেকেই ভুল পথে রয়েছে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত সেলফোন অপারেটরটি। ফলে ধরা দেয়নি ব্যবসায়িক সাফল্য। সেবার ক্ষেত্রেও এ খাতের অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে তারা। টেলিটক তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে টেলিটক। প্রতিষ্ঠানটির অনুমোদিত মূলধন ২ হাজার কোটি টাকা। পরের বছরের ৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে টেলিটকের সেলফোন সেবাদান কার্যক্রম শুরু হয়। মূলত চারটি লক্ষ্য নিয়ে টেলিটক প্রতিষ্ঠা করা হয়। এগুলো হলো— রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে সেলফোন সেবা প্রদান, সরকারি ও বেসরকারি খাতের সেলফোন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার মাধ্যমে জনগণের সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা, সেলফোন সেবার উচ্চ চাহিদার একটি অংশ পূরণ ও রাজস্ব আয়ে সরকারের একটি নতুন উৎস তৈরি। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নেটওয়ার্ক অবকাঠামো বিনির্মাণ ও সম্প্রসারণে প্রাথমিকভাবে সেলফোন সেবা খাতে প্রচুর বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বেসরকারি খাতের অন্য পাঁচ সেলফোন অপারেটরের তুলনায় টেলিটকের বিনিয়োগ সামান্যই। আর বিনিয়োগ কম হওয়ায় অন্য অপারেটরদের মতো নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণও করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। এতে গ্রাহকদের প্রত্যাশিত সেবা নিশ্চিত করাও সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে টেলিটক বিনিয়োগ করেছে ৩ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। এ বাবদ গ্রামীণফোনের বিনিয়োগ প্রায় ৪০ হাজার কোটি, বাংলালিংকের ২৮ হাজার কোটি, রবির ২৫ হাজার কোটি, এয়ারটেলের ১৪ হাজার কোটি ও সিটিসেলের ৫ হাজার কোটি টাকা। শুরুতে টেলিটকের জন্য যে বিনিয়োগ প্রয়োজন ছিল, তা করা হয়নি বলে মনে করেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, কার্যক্রম পরিচালনাকারী বেসরকারি সেলফোন অপারেটরদের তুলনায় অনেক কম বিনিয়োগ নিয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে বাজার দখলে টেলিটকের যে সম্ভাবনা ছিল, তা কাজে লাগানো যায়নি। বাজারে ভালো অবস্থান তৈরি করতে শুরুতে যে ধরনের পদক্ষেপ প্রয়োজন ছিল, তা নেয়া হয়নি। এতে ধরে রাখা যায়নি টেলিটক নিয়ে গ্রাহকের আগ্রহ। টেলিটকে মূলত প্রকল্পের ভিত্তিতে অর্থায়ন করা হচ্ছে। থ্রিজি প্রযুক্তি চালু ও বিদ্যমান টুজি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের জন্য ২০১০ সালের ডিসেম্বর চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তি করে টেলিটক। ২১ কোটি ১০ লাখ ডলারের এ প্রকল্পে সহায়তা দিয়েছে চীনের এক্সিম ব্যাংক। এর মাধ্যমে দেশব্যাপী ৬৫ লাখ গ্রাহককে যুক্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করে প্রতিষ্ঠানটি। বিনিয়োগ সীমিত হওয়ায় প্রত্যাশিত মাত্রায় থ্রিজির নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে প্রতিষ্ঠানটি সূত্রে জানা গেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে লাইসেন্স ফি ও অন্যান্য বকেয়া আদায়ের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড়ও পেয়েছে টেলিটক। পরীক্ষামূলক থ্রিজি সেবা চালুর পর অনুমোদন পেলেও পরবর্তীতে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে তাদেরও নির্দিষ্ট ফি পরিশোধ করে লাইসেন্স নেয়ার কথা। ২০১৩ সালের অক্টোবরে থ্রিজির লাইসেন্স ফি হিসেবে ১০ কোটি টাকা পরিশোধ করে টেলিটক। একই সঙ্গে ভ্যাট হিসেবে আরো ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করে তারা। আর্থিক সংকটের কথা উল্লেখ করে টেলিটকের পক্ষ থেকে থ্রিজির তরঙ্গ বরাদ্দ ফি দেয়া সম্ভব নয় বলে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হয়। পরবর্তীতে তরঙ্গ ফি বাবদ পাওনা ১ হাজার ৭১৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকার মধ্যে ৫০ কোটি টাকা পরিশোধ করে টেলিটক। ২০১২ সালের ১৪ অক্টোবর দেশে প্রথম থ্রিজি প্রযুক্তির সেবা চালু করে টেলিটক। বাণিজ্যিক পরীক্ষণের ভিত্তিতে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে টেলিটককে এ সেবা চালুর অনুমতি দেয়া হয়। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতের চার প্রতিষ্ঠান থ্রিজির লাইসেন্স পায়। একই বছর প্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্যিকভাবে সেবাদান শুরু করে। তবে আগে সেবাদান শুরু করলেও থ্রিজি সেবার ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পিছিয়ে পড়ছে টেলিটক। টেলিটকের থ্রিজি বিটিএসের (নোড-বি নামে পরিচিত) সংখ্যা ১ হাজার ৫০০। অন্যদিকে গ্রামীণফোনের থ্রিজি বিটিএস রয়েছে ২ হাজার ৫০০, বাংলালিংকের ১ হাজার ৯৮০, রবির ১ হাজার ৬৫৫ ও এয়ারটেলের ১ হাজার ৩০০টি। এছাড়া টেলিটকের টুজি বিটিএসের সংখ্যা মাত্র ৩ হাজার ৫০০। অথচ প্রায় একই সময়ে সেবাদান শুরু করা বাংলালিংক এরই মধ্যে ৮ হাজার ৩৩০টি বিটিএস স্থাপন করেছে। তারও পর সেবাদান শুরু করা এয়ারটেলের টুজি বিটিএসের সংখ্যা ৬ হাজার ১০০টি। এছাড়া গ্রামীণফোন ৯ হাজার ৮৯০, রবি ৮ হাজার ৩০০ ও সিটিসেল ২ হাজার ৭০০ বিটিএসের মাধ্যমে টুজি সেবা দিচ্ছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী এ বিষয়ে বলেন, ‘টেলিটকের টাওয়ার সংখ্যা অনেক কম। দেশের প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকায় সেভাবে ব্যবসা নেই। তার পরও সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে টেলিটককে সেসব স্থানে টাওয়ারে বিনিয়োগ করতে হয়েছে। ব্যবসার চেয়ে সেবা প্রদানের বিষয়টিতে টেলিটক বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। টাওয়ারে বিদেশী বিনিয়োগ আনতে আমরা কয়েকটি দেশের সঙ্গে কথা বলছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘টেলিটকের প্রবৃদ্ধির জন্য আমরা কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করি, একটা ভালো বিনিয়োগ এলে টেলিটকের বিনিয়োগে খরা অনেকটা কেটে যাবে। পাশাপাশি সরকারি বিনিয়োগের প্রেক্ষাপট তৈরি করতে হবে। লাভজনক হিসেবে প্রমাণ করতে পারলে টেলিটকে বিনিয়োগের অভাব হবে না। প্রতিনিয়তই টেলিটক নিয়ে ব্যবসায়িক সক্ষমতা বাড়াতে পরিকল্পনা করছি। এগুলো কার্যকর হলে টেলিটক একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাজার দখলে নিতে পারবে।’ নিজেদের নেটওয়ার্কে খুব বেশি গ্রাহকও যুক্ত করতে পারেনি টেলিটক। থ্রিজি চালুর আগে প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক ছিল ১৬ লাখ ২৪ হাজার। টুজি ও থ্রিজি মিলিয়ে টেলিটকের বর্তমান গ্রাহক সংখ্যা ৪০ লাখ ৭৯ হাজার। আর গ্রামীণফোনের গ্রাহক সংখ্যা বর্তমানে ৫ কোটি ৫০ লাখ ৪০ হাজার, বাংলালিংকের ৩ কোটি ২৮ লাখ ৭৯ হাজার, রবির ২ কোটি ৮৩ লাখ ১৬ হাজার, এয়ারটেলের ৯৩ লাখ ৯২ হাজার ও সিটিসেলের ১১ লাখ ৩৮ হাজার।

Source