-সুশান্ত সিনহা
সম্প্রতি দিল্লি যাওয়ার সুবাদে সেলফোন কোম্পানির সিম কিনতে বেরিয়েছিলাম। সুযোগ-সুবিধা আর সময় বিবেচনায় ১৫০ রুপিতে পছন্দ হলো সিম। কিন্তু বিপত্তি বাধল নিবন্ধনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে। ওদের নিয়ম অনুযায়ী পাসপোর্ট বা পরিচয়পত্রের ফটোকপির সঙ্গে দিতে হবে এক কপি ছবি। পাসপোর্ট ও ভিসার সঙ্গে ছবি আছে জানিয়েও রক্ষা হলো না। ছবি নেই শুনে উপায় বাতলে দিলেন, পাশের দোকানে ছবি তোলা হয় বলেও জানালেন। ১৫০ রুপির একটা সিম বিক্রিতে লাভ যা-ই হোক না কেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে এতটুকু ছাড় দিতে রাজি নন তিনি। তার নাছোড়বান্ধা অবস্থা দেখে কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করায় জানালেন, ‘বিক্রেতা হিসেবে গ্রাহকের সব কাগজপত্র তাকে পাঠাতে হবে। কোনো ঘাটতি থাকলে গুনতে হবে জরিমানা। দোকানির এমন শঙ্কা দেখে কাগজপত্র ঘেঁটে একখান ছবি এবং স্থানীয় ঠিকানা হিসেবে হোটেলের ফোন নাম্বারসহ বিস্তারিত লিখে উতরে গেলাম প্রথম ধাপ।
সিম পেয়ে তাত্ক্ষণিকভাবে কল করার সুযোগ নেই ভারতে। সক্রিয় হতে লাগবে প্রায় ১৫-২০ ঘণ্টা! শুনে আক্কেলগুড়ুম, আমরা তো সিম কিনেই নগদে নগদে কথা বলি আর এ ব্যাটা বলে কিনা আগামীকালের আগে কথা বলা সম্ভব নয়! কাগজ পৌঁছলে তারা খতিয়ে দেখবে আর তাতেই ১৫-২০ ঘণ্টা লাগবে। বিক্রেতা সিমের কাগজে একটা নম্বর লিখে দিয়ে বললেন, সিম চালু হলে এ নম্বরে কল দিতে হবে। তারা আপনার নাম, ঠিকানা ও জন্মতারিখসহ প্রদেয় তথ্য মিলিয়ে দেখবেন, যদি ঠিক থাকে তবেই এর কিছুক্ষণের মধ্যে সিমে কথাবার্তা বলতে পারবেন! ভারি বিপত্তি, লিখিত পরীক্ষার পর আবার মৌখিক পরীক্ষা? অপেক্ষার পালা শেষে যথারীতি ওই নম্বরে কল দিতেই এয়ারটেলে সুস্বাগতম জানালেন। গ্রাহকসেবার কথা বলেই তিনি একে একে আমার নাম, জন্মতারিখ ও পাসপোর্ট নম্বর জিজ্ঞেস করলেন। উত্তর মিলে যাওয়ায় জানালেন কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনার সিম পুরোপুরি চালু হবে এবং আপনি দেশে-বিদেশে কল করতে পারবেন। মিনিট পাঁচেক পর কাঙ্ক্ষিত নম্বর পেয়ে দেশে জানালাম গতকাল দুপুরে আমরা নিরাপদে পৌঁছেছি!
গল্প নয়, সত্যি। এ পদ্ধতি মেনেই আপনাকে সিম কিনতে হবে। দিল্লি শহরে চাইলেই যেখানে সেখানে রিচার্জ করার সুযোগ নেই। নির্দিষ্ট এলাকায় নির্দিষ্ট কিছু দোকানে রিচার্জ হয়। আমরা তো হাত বাড়ালেই যখন তখন ফেক্সিলোড করতে পারি! মুশকিল আসান হলো ইমার্জেন্সি ব্যালান্স পাওয়ার এসএমএস দেখে। তাত্ক্ষণিকভাবে অনুরোধ পাঠিয়ে সে আশায় গুড়েবালি! দুঃখিত বলে সাফ জানিয়ে দিল, ‘গ্রাহক হিসেবে পাঁচদিন অতিবাহিত না হলে এ সুবিধা মিলবে না।’ ইমারজেন্সিতেও এতটুক ছাড় নেই, কী বিচ্ছিরি নিয়ম রে বাবা! সিম কাহিনী যেন শেষই হয় না। ১০০ রুপি রিচার্জে মিলল ৭৫ রুপির মতো। বাকিটা সরকার ঘ্যাচাং করে কেটে নিয়েছে ট্যাক্স ও ভ্যাট বাবদ। নগদে ২৫ রুপি ভারত সরকারের কোষাগারে জমা পড়ল। ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এ অবদান নেহাত ফেলনা নয়! পদ্ধতি সহজ, সরল হিসাব, এতে ফোন কোম্পানিগুলোর কর-ভ্যাট ফাঁকিজুঁকি নিয়ে আর হইচই করার দরকার পড়ে না। আবার কলপ্রতি না কেটে এ পদ্ধতিতে একসঙ্গে বেশি টাকাও পাচ্ছে সরকার। বছর পাঁচেক আগে কলকাতায় গিয়ে সিম কিনতেও একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল। দোকানিদের শিক্ষাদীক্ষায় খুব যে বড় কিছু তা মনে হয়নি, কিন্তু সিম বিক্রিতে বেঁধে দেয়া নিয়ম পালনে এক চুল ছাড় নেই। এতে প্রত্যেক সিম ব্যবহারকারীর বিস্তারিত তথ্য পাচ্ছে ফোন কোম্পানিগুলো ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ঘটা করে রেজিস্ট্রেশন করার উত্সব করা বা কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দেয়ার দরকার নেই দেশটির। নিয়ন্ত্রক সংস্থা চাইলে সহজেই জানতে পারবে সংশ্লিষ্ট ফোন নাম্বারটির ব্যবহারকারী কে। একজন নাগরিক পরিচয়পত্র দিয়ে সর্বোচ্চ ১০টি সিম কিনতে পারেন। যদিও আমরা এসবের ধার ধারি না। কিসের পরিচয়পত্র, কিসের নিবন্ধন! বেশির ভাগ সিমের নেই নিবন্ধন। যা আছে তাও ভুলে ভরা। একটি মাত্র পরিচয়পত্র দিয়ে অর্ধলক্ষ সিম নিবন্ধনের খবর এসেছে গণমাধ্যমে সম্প্রতি! সুতরাং আমাদের অপারেটর কোম্পানিগুলো কতখানি অসচেতন তা বুঝতে এ তথ্য যথেষ্ট নয় কি? গ্রাহকের তথ্য সংরক্ষণের দায় যে একান্তই তাদের, এটা তারা বেমালুম চেপে যাচ্ছে!
উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা নেই, বৃহত্ প্রতিবেশী দেশ ভারতবর্ষ, যাদের আর্থসামাজিক সূচকগুলো কমবেশি আমাদের মতোই। তাদের এমন নিয়মকানুন দেখে অবাক হয়েছি। নিশ্চয় ওখানেও চোর-বাটপারসহ অসাধু ব্যক্তির সংখ্যা কোনো অংশে কম নয় এবং এ নিয়মের যে ব্যতিক্রম হচ্ছে না, তা নয়। তবে তা সংখ্যায় যথেষ্ট কম বলেই মনে হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, বিনা খরচে সব সিম ব্যবহারকারীর ছবিসহ তথ্য সংরক্ষণ করা যাচ্ছে। শুরু থেকে এ উদ্যোগ থাকায় আলাদা করে আর রেজিস্ট্রেশন করার যেমন দরকার নেই, তেমনি বাড়তি লোকবল ছাড়াই বিশাল এ দক্ষযজ্ঞ এগিয়ে চলছে। এতে চাইলেই পথে-ঘাটে সিম কিনে সঙ্গে সঙ্গে কাউকে হুমকি-ধমকি দেয়ার সুযোগ মিলবে না। বাংলাদেশে এ প্রথা চালু করলে ফোনকেন্দ্রিক নানামুখী অপকর্ম-অত্যাচার কমে আসবে অনেকাংশে। নিয়মের এ অনুশাসন শক্তি জোগাবে ভেতর থেকে, যা মোটেও আমলে নেয়া হয়নি আমাদের দেশে। কোম্পানিগুলো যেকোনো মূল্যে সিম বিক্রি বাড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় দেখেছি, বস্তা বস্তা কমলা বিতরণ করা হয়েছে সিম বিক্রির কৌশল হিসেবে। কেউ আবার রাত ১২টার পর থেকে ভোর পর্যন্ত বিনা পয়সায় কথা বলার সুযোগ দিয়েছে, হাজারখানেক এসএমএস ফ্রি দেয়াসহ আরো কত কিছু বিপণন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে তারা। শুধু গ্রাহকের তথ্য যে দেশের স্বার্থে সংরক্ষণ জরুরি, সেটা অনুধাবন করেনি। এখন ১০ কোটির বেশি সিম বিক্রির পর বলা হচ্ছে সিম নিবন্ধন করতে। বৈঠক করে ঢোলশহরত হচ্ছে এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে। বিশাল এ কর্মযজ্ঞ শুরু হলেও সাড়া মিলেছে যত্সামান্যই। যে কাজ নির্বিঘ্নে-ঝামেলাহীনভাবে করা যেত, তা না করায় এখন হুলিয়া জারি করতে হচ্ছে, অভিযান চালিয়ে বাধ্য করানোর চেষ্টা চলছে। কী তেলেছমাতি কাণ্ড! একেই বলে সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়! এখন বলা হচ্ছে, এসএমএসের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করলে হবে না। প্রত্যেককে নিজ সিম নিয়ে সেলফোন কোম্পানির নিদিষ্ট কার্যালয়ে গিয়ে আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। কাজটি শহরে কিছুটা সহজ হলেও গ্রামে কঠিন। এক্ষেত্রে প্রচারণা ও সময়ের স্বল্পতা বড় সমস্যা। দেখার বিষয়, সরকার এ বিশাল কর্মযজ্ঞ কিভাবে শেষ করে। শুধু করলেই হবে না, এ প্রক্রিয়া সর্বদা চালু রাখতে হবে।
সেলফোন সিম ব্যবহারের শীর্ষে রয়েছে চীন ও ভারত। ১২৫ কোটি ব্যবহূত সিমের মাধ্যমে চীনের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ এ সেবার আওতাভুক্ত। অন্যদিকে ভারতে বিক্রি হয়েছে ৯৮ কোটি সিম, যার মধ্যে সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৮৮ কোটি ১ লাখ। ভারতের টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি-টিআরএআইয়ের সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদন অনুযায়ী মোট গ্রাহকের মধ্যে ভারতী এয়ারটেল অংশীদার ২৪ ভাগ, ভোডাফোন ১৯, আইডিয়া ১৭, রিলায়েন্স ১১, এয়ারটেল ৮, সরকারি সংস্থা বিএসএনএল ৮, টাটা ৬ এবং অন্যদের অংশ ৭ ভাগ। এমনকি কোন প্রদেশে কতজন সেলফোন ব্যবহার করছে, স্মার্টফোন, তারযুক্ত ও তারহীন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যাসহ সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত মিলবে সমৃদ্ধ প্রতিবেদনটিতে। অনেক সময় কেউ কেউ বলে থাকেন, বাংলাদেশে এত বেশি মানুষ বলে সব নিয়মকানুন মেনে চলা সম্ভব হয় না। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকার ও অপারেটর কোম্পানিগুলোর দু-একজনের মনোভাব এমনই। এ যুক্তি কতটা অসাড়-খেলো, তা বুঝতেই চীন-ভারতের প্রসঙ্গ টানা। দেশের শীর্ষ মোবাইল ফোন সেবাদানকারী কোম্পানির সংবাদ সম্মেলনে এক সংবাদিক জানতে চেয়েছিলেন, তাদের গ্রাহক কত এবং এর মধ্যে সক্রিয় গ্রাহক সংখ্যা কত? মোট গ্রাহকের উত্তর দিলেও নিজ কোম্পানির সক্রিয় গ্রাহকের তথ্য জানাতে পারেননি প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ নির্বাহীরা! অন্যদের অবস্থা এর চেয়ে ভালো তা আশা করা যায় না। যদিও এটা তাদেরই জানার ও জানানোর কথা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, সেলফোনের সিম তো আর আমদানি করা কিংবা নকল কারখানায় বানানো যায় না। যদিও দেশের অলিগলিতে মুড়ি-মুড়কির মতো বিভিন্ন কোম্পানির সিম বিক্রি হচ্ছে। টক টাইমসহ নানা অফারও দিচ্ছে! পথে হাঁটতে হাঁটতে সিম কিনে যে কাউকে হুমকি-ধমকি দেয়া যায় সহজেই। ব্যবহার শেষে সিমটা ফেলে দিলেই ল্যাটা চুকে গেল। ধরা পড়ার ভয় নেই, কারণ সিম কিনতে দিতে হয়নি ন্যূনতম পরিচয় শনাক্তকরণের কাগজ! ভাবটা এমন যে, টাকা দিয়ে কিনছি এই বড়; আবার পরিচয়পত্র-ছবি! দোকানিও যেন এক ডালি বিক্রি শেষ করতে পারলেই আরেক ডালি নিয়ে বসতে পারেন! ফলে উইন উইন সিচুয়েশন ক্রেতা-বিক্রেতার! এজন্যই জিনের বাদশা পরিচয় দিয়ে শত শত মানুষকে প্রতারণা করা হচ্ছে! চাঁদাবাজিসহ হত্যার হুমকি অবলীলায় দিতে পারছে সন্ত্রাসীরা। ভুক্তভোগীরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দারস্থ হলেও প্রতিকার মিলছে খুব কম। তাদেরও কিছু করার থাকছে না বলে দেশে বাড়ছে অপরাধ, আর্থিক ক্ষতি ও দুর্ভোগ; সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে র্যাব-পুলিশের উটকো কাজ। অথচ সহজেই এসব ক্ষয়ক্ষতি-অপরাধ কমিয়ে এনে জননিরাপত্তা কিছুটা বাড়ানো যেত। এজন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে গবেষণা বা নতুন প্রকল্প নেয়া কিংবা তথ্যপ্রযুক্তিতে বাঘা কোনো প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়ার প্রয়োজন নেই! শুধু কোম্পানিগুলোর সিম রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া ঠিকভাবে পালন করলেই চলত। যা যথাযথভাবে মেনে চলছে চীন-ভারতের কোম্পানি ও সামান্য দোকানিরা! কিন্তু আমরা তো এসবের ধার ধারি না। এখন পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে গেছে, ১০ কোটি গ্রাহককে নতুন করে রেজিস্ট্রেশন করানো সত্যিই বিশাল কর্মযজ্ঞ!
তবে হালে কঠিন কঠোর নিয়ম হয়েছে, অবৈধ নিবন্ধনের জন্য রেজিস্ট্রেশনের কথা বলা হচ্ছে বিজ্ঞাপন মারফত। মাথায় রাখতে হবে আর পাঁচটা ব্যবসার মতো মোবাইল ফোন অপারেটরদের ব্যবসা নয়। একটা নিবন্ধনহীন সিম দিয়ে বহু রকম জালিয়াতির ঘটনা ঘটার শঙ্কা থাকে। আর চীন-ভারত প্রায় ২০০ কোটি মানুষের সিম নিবন্ধন সুষ্ঠু-সুন্দরভাবে করতে পারলে আমরা কেন ১০ কোটি সিমের হিসাব রাখতে পারব না? সংখ্যা বড় সমস্যা নয়, সমস্যা হলো ধাপে ধাপে নিয়মকানুনগুলো তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা। আর এ অবজ্ঞা-উপেক্ষার খেসারত দিচ্ছে পুরো দেশ।
Source